সাদত হাসান মান্টো: দেশভাগের গল্পকার
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হিন্দুঅধ্যুষিত ভারত এবং মুসলিম-অধ্যুষিত পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম। উদ্দেশ্য দুই অঞ্চলে শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। দেশভাগ ব্যাপক রক্তপাতের জন্ম দেয়, যাতে ১০ লাখের বেশি মানুষ নিহত হন এবং প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হন; কিন্তু আলাদা হওয়ার পর থেকেও দুই রাষ্ট্রে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির দাবানল আরও প্রকট হয়ে উঠল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কাশ্মীর ইস্যুতে সম্প্রতি দুদেশের মধ্যে সংঘাত চলমান।
সাতচল্লিশের দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ততা, ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদে নির্মিত এক ভয়াবহ সমাজের অবক্ষয় গভীর অনুধাবন করেছিলেন যে সাহিত্যিক, তিনি উর্দু সাহিত্যের বিশ্বখ্যাত কথাশিল্পী সাদত হাসান মান্টো। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার সমগ্র সাহিত্যজীবনে। গল্পে গল্পে প্রকাশ করেছেন দেশভাগের বেদনা। নিজের গল্প সম্পর্কে মান্টো বলে যান ‘যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি তার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় না থাকে তবে আমার গল্প পড়ুন। যদি আমার গল্প সহ্য করতে না পারেন তবে বুঝতে পারবেন সময়টা দুর্বিষহ এবং প্রতিকূলে।’
বৈচিত্র্যময় চরিত্র মান্টোর। কখনো তিনি বিপ্লবী, কখনো নিষিদ্ধ, কখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে প্রবল সোচ্চার ছিলেন তিনি। মান্টো প্রতিটি বাক্যে দেশভাগের অসীম যন্ত্রণায় নিষ্ঠুরতম সত্যটি বলে ফেলতেন। শাসক শ্রেণির চরম চক্ষুশূলে পরিণত হতে হয়েছিল মান্টোকে। খোদ জন্মভূমি ভারতেই তার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয়েছিল তিনবার।
মান্টোর লেখা ‘খোল দো’ গল্প প্রকাশের দায়ে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘নাকুশ’-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ৬ মাসের জন্য। ‘ঠান্ডা গোস্ত’ প্রকাশের জন্য জরিমানা করা হয়েছিল ‘জাবেদ সাময়িকী’ কে। তার লেখা ‘আউর দরমিয়ান’-এর ছাপা নিষিদ্ধ করা হলে কোনো পত্রিকাই মান্টোর পরবর্তী কিস্তিগুলো ছাপতে রাজি হয়নি। ১৯৫০ সালের আগস্টে ‘বিটার ফ্রুট’ গল্পের জন্যে অশ্লীলতার অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত হয়ে যেতে হয়েছিল লাহোর আদালত প্রাঙ্গণ পর্যন্ত।
শুধু তাই নয়, চরম আর্থিক দুরবস্থার কারণে ভালো আইনজীবীও নিয়োগ করতে পারেননি মান্টো। স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে এসেছিলেন তরুণ আইনজীবী শেখ খুরশিদ আলম। তিনিসহ তিনজন তরুণ আইনজীবী মান্টোর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে নানাভাবে মুছে ফেলতে চেয়েছিল শাসকরা; কিন্তু মান্টো হয়ে উঠলেন সর্বকালের। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, যে মান্টোকে আজ বলা হয় উর্দু সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পকার, সেই মান্টো স্কুলের ক্লাসের উর্দু পরীক্ষায় কখনো উত্তীর্ণ হতে পারেননি। আবার সেই মান্টোই হিন্দু মহাসভা কলেজ থেকে টানা দুবার এফএ পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।
মান্টোর গল্প লেখা সম্পর্কে জানা যায়, তার মাথায় যখন নতুন গল্প লেখার ভাবনা আসত তখন তিনি সারারাত ভাবতেন কীভাবে গল্পের শুরুটা হবে। ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলত পড়া। যদি মিলে যায় গল্পের নতুন বিষয়। কখনো স্ত্রীর সঙ্গে বিনা কারণে ঝগড়া। তাতেও যদি মেলে গল্পের খোঁজ। আর শেষ অবলম্বন খানিকটা ভিন্ন। রাস্তায় নেমে প্রথমে একটি পান কিনে চোখ বুজবেন মান্টো। অতঃপর জীবন দেখতে দেখতে গল্প লেখার রসদের খোঁজ।
মান্টোর বিখ্যাত গল্প ‘টোবা টেক সিং’ গল্পে দেখা যায়, বিষান সিং নামের এক অমুসলিম পাগলের নির্মম চিত্র। দেশভাগের দুই তিন বছর পরে দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাগলদেরও ভাগাভাগি হবে। অর্থাৎ অমুসলিম পাগলদের ভারত এবং মুসলিম পাগলদের পাঠানো হবে পাকিস্তানে। লাহোরের মানসিক হাসপাতালে থাকা পাগল বিষান সিং বাকি সহ-বন্দিদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে কী করে নিজ গ্রামে ফেরা যায়। যেহেতু সে অমুসলিম তাই ভারতে চলে যেতে হবে তাকে; কিন্তু বিষান সিং ফিরে যেতে চায় পাকিস্তানে তার প্রিয় গ্রাম টোবা টেক সিং-এ।
যে মান্টো একসময় স্বপ্ন দেখতেন তিনি ভগত সিংহের মতো ইংরেজ তাড়াচ্ছেন। অন্যদিকে দিনভর অমৃতসরের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা আর দুচোখজুড়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন। মান্টোর পকেটে সিগারেট, রোদের মধ্যে এপার থেকে ওপাড়, বিরাম নেই তার মান্টোর সিগারেট ফুঁকছেন আর ইংরেজ তাড়িয়ে বিপ্লবের স্বপ্নে কাতর হচ্ছেন সেই মান্টোই এখন বাধ্য হয়ে মাতৃভূমি ছেড়ে পালাতে চাইছেন অচেনা ভূমি পাকিস্তানে। তার চতুর্দিকের চেনা জগৎ আজ অচেনা। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বোম্বাই ছেড়ে লাহোর চলে গেলেন মান্টো। যাওয়ার সময় যে জিনিস দেখে চোখে জল এলো মান্টোর। কেউ আসেনি তাকে বিদায় জানাতে একমাত্র বন্ধু অভিনেতা শ্যাম ছাড়া।
লাহোরে আসার পরেও দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি মান্টোর। এতদিনের চিরচেনা মাতৃভূমি ছেড়ে নতুন দেশের নতুন জগতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারলেন না মান্টো। অচেনা দেশ, অচেনা ভূমি। চাকরি নেই তার। উপার্জনের একমাত্র উপায় পত্রিকায় গল্প লেখা। প্রত্যহ বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়ে পত্রিকা অফিসে গিয়ে বলতেন ‘টাকা দিন, লিখে শোধ করে দেবো।’ একজন লেখক কিংবা গল্পকারের জন্য এটি উচ্চারণ যে কতটা নিষ্ঠুর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে মান্টো একসময় গল্পের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করতে দ্বিধা করতেন না। যে মান্টো খবরের কাগজের আদ্যোপান্ত খুঁজে বেড়াতেন কাহিনীর খোঁজে। সেই মান্টোর গল্পের রসদ চুকেছে বটে কিন্তু তা রীতিমতো বাধ্য হয়ে।
মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক মান্টো সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে পৃষ্ঠা দেড়েক। এভাবে লেখা ৩২টা গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সিয়াহ হাশিয়ে’ বা কালো সীমানা। মাত্র ৪২ বছরের জীবন পরিধি ছিল মান্টোর। জীবনের ২২তম বছরে ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত ‘The last Day of a Condemned Man’ এর উর্দু অনুবাদ ‘সারগুজাসত-ই-আসির’ এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যে হাতেখড়ি মান্টোর। পরের ২০ বছরে ২২টি ছোটগল্পের বই, তিনটি স্মৃতিকথা, একটি উপন্যাসের জন্ম মান্টোর হাতে। নিজের জীবনের সমস্ত সাক্ষ্য আর আত্মোপলব্ধি নিজের গল্পের চরিত্রের মধ্য দিয়েই ঢেলে সাজিয়েছেন মান্টো।
মান্টোর মৃত্যুও ছিল বেদনায় ভরা। ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি সকালে লিভার সিরোসিসের কঠিন ধকলে কঙ্কালসার দেহে মান্টো তার স্ত্রীকে জানান পেটের সীমাহীন যন্ত্রণার কথা। মান্টো বুঝতে পারছিলেন এবার তার অন্তিম মুহূর্ত চলে এসেছে। তবে হাসপাতালে যেতে তিনি রাজি হলেন না। মদ এখন বিষ জেনেও বারবার মরার আগে শয্যায় সুধা পানের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলেন মান্টো। তাকে থামাতে অবশেষে দেওয়া হলো মদিরার কয়েক ফোঁটা। তবে সেই ফোঁটা ভেতরে গেল না, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলো।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর অ্যাম্বুলেন্সে বসে ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন মান্টোর প্রাণবায়ু এর মধ্যেই চলে গেছে। সময় তখন বরাবর সকাল সাড়ে ১০টা। ওই দিনই ঠিক করা হলো, বিকেল ৪টার মধ্যে মান্টোর দাফন কাজ শেষ হবে। পরে মৃতদেহের অবস্থা বিবেচনা করে বেলা সাড়ে ৩টার মধ্যে সব কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত হলো।
মান্টো মারা যাওয়ার পর রেডিও লাহোর থেকে বারবার তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হয়, যেখানে তার প্রবেশ বেঁচে থাকতে একরকম প্রায় নিষেধই ছিল। মান্টোর জানাজায় বহু মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। তাকে শেষবারের দেখা দেখতে লাহোরের মানুষজনের মধ্যে ছিল বেশির ভাগ তরুণ, ছাত্র-শিক্ষক, আমজনতা এমনকি অনেক বোরকা পরা নারী, যাদের সম্পর্কে অনুমান করা হয়, তারা সমাজ পরিত্যক্ত পেশাজীবী, যাদের জীবনের কঠিন প্রতিচ্ছবি মান্টো দরদে এঁকেছিলেন গল্পে। জানাজা শেষে লাহোরের মিয়ানি সাহেব কবরস্থানে চিরদিনের মতো শায়িত হলেন সাদত হোসেন মান্টো।
মান্টোকে আখ্যায়িত করায় হয় দেশভাগের গল্পকার গল্পকার হিসেবেও। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে মান্টো এপিটাফে লেখা ছিল, ‘কে বেশি ভালো গল্প লিখতে পারে? খোদা নাকি মান্টো?’ কিংবদন্তি গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর ১১৩তম জন্মদিন আজ। এ দিনে তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে