সাদী মহম্মদের আত্মহনন ও জাতির দেউলিয়াত্ব
আমি সংগীত শিল্পী নই। সংগীতপ্রেমী। গান শুনতে ভালোবাসি। সংগীতপ্রেমী হলেও সব ধরনের গান ভালো লাগে না। ব্যান্ডের গান সচরাচর শুনি না। আমি শুনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি। শুনি অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, ডিএল রায়, পুরোনো দিনের আধুনিক এবং মরমিগান। রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আকর্ষণ বেশি। রবিঠাকুরের বাণী সব সময় বুঝি তা না; কিন্তু সুরের আবেশ আমাকে মোহিত করে।
সবাই যে আমার মতো হবে, তা নয়। আমার ছেলে অর্ণব কোনো দিন রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি শুনেছে বলে মনে হয় না। মেয়ে ঐশী আমার অনুরোধে রবীন্দ্রসংগীতের অনুশীলন করে। আমাদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, নিজামউদ্দিন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষের মতে, রবিঠাকুরের সব গানের সুর এক রকম। লং প্লেয়ারে কখন যে গান থেকে গানের পরিবর্তন হয়, তা তিনি ধরতে পারতেন না। অন্যদিকে আমার ভাই মহিউদ্দিন আহমদ শুধু রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য আরও বেশি দিন বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমি প্রায় প্রতিদিই ঢাকা থেকে গাজীপুর টাকশালে গিয়ে অফিস করতাম। পথে যেতে-আসতে দশ বছর ধরে গাড়িতে বসে বসে গান শুনেছি। অধিকাংশ গান ছিল সাদী মহম্মদের কণ্ঠে। ডিএল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ এবং রজনীকান্ত সেনের ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’- এই দুটি গান সাদী মহম্মদের কণ্ঠে আমার কাছে অতুলনীয় মনে হতো।
সাদী মহম্মদ তকিউল্লাহ ছিলেন মূলত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। বুধবার ১৩ মার্চ, ২০২৪; সন্ধ্যায় তাদের নিজ বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় শিল্পী সাদী মহম্মদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর দিন তিনি রোজা রেখেছিলেন, ইফতারও করেছিলেন; এরপরই তিনি স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন।
তাদের ঘনিষ্ঠতম স্বজন নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার কথা অনুযায়ী, গত বছর তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে সাদী মহম্মদ নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। মায়ের মৃত্যুতে তার মধ্যে হতাশা ভর করেছিল। বাবার মৃত্যুর পর মা কাপড় সেলাইয়ের আয় দিয়ে ১০টি সন্তানের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। মাকে হারিয়ে সাদী মহম্মদ মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছেন, হয়তো এ কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
কিন্তু মায়ের মৃত্যু সাদী মহম্মদের আত্মহননের একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। অনেকের অভিমত, সাদীর অনেক আগেই পাগল হয়ে যাওয়া কথা। সাদী কেন এতদিনেও পাগল হননি- প্রায়ই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সাদীকেও। এবার সেই ঘটনায় আসি। সাদীর বাবা মহম্মদ সলিমুল্লাহ ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ধার্মিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি মসজিদে আদায় করতেন। মসজিদে নামাজ পড়ার জন্যই তিনি মসজিদের পাশে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন।
২৬ মার্চ, ১৯৭১, শুক্রবার; জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন মহম্মদ সলিমুল্লাহ। সাদীদের পাশের অবাঙালি বাড়ি থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। নামাজ শেষে অবাঙালি বিহারিরা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিতে থাকে যে, সলিমুল্লাহদের বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে গুলি করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে বিহারিরা মহম্মদ সলিমুল্লাহর বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাদীদের পরিবারের সদস্যরা পাশের বাসার ছাদে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। সাদীর মার দুই পা ভেঙে যায়। ৯৬ বছর বয়সে তিনি গত বছর মৃত্যুবরণ করেন। আমৃত্যু তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেছেন। সাদী এবং তার বাবা পাশের খালি বাসায় আশ্রয় নেন। তাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান এয়ারফোর্সের এক পাঞ্জাবি অফিসার ঘরে ঢুকে সাদীর বাবাকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে। সলিমুল্লাহ সাহেব আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সাদী তার ছোট হাত দিয়ে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত চেপে ধরেন। বাবা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই পালা’। পালানোর সময় সাদী পথিমধ্যে দেখেন তার চাচাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। দেখেন খালাতো ভাইকে মাটিতে শুইয়ে গরুর মতো জবাই করার দৃশ্য। এ ছাড়াও পালানোর পথে বিহারিদের হত্যাযজ্ঞে অনেক নিরীহ মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। এতগুলো মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার পরও সাদী কেন পাগল হননি, সেই প্রশ্ন জাগারই কথা। সাদী পাগল না হলেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন বলে মনে হয় না।
সাদী মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালে। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বুয়েটে লেখাপড়া শেষ না করেই তিনি ১৯৭৫ সালে চলে যান ভারতের শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেখানে তিনি শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখেন। ষাটটিরও বেশি গানের অ্যালবাম রয়েছে তার। সাদী মহম্মদ ছিলেন একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার। গানের জগতে এমন প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদকের জন্য বিবেচিত হননি।
রাষ্ট্রীয় পদক না পাওয়ার একটা অতৃপ্তি তার থাকতেই পারে। রাষ্ট্রীয় যারা পদক পেয়েছেন, তারা সবাই যে সাদীর চেয়ে বেশি প্রতিভাবান, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের গানের ভুবনে সাদীর অবদান অপরিসীম। তার চেয়ে আরও অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে। নানা পদকে ভুষিত করেছে। স্বীকৃতি না পাওয়ার এই হতাশাকে গভীর করে তুলেছে চলতি বছরে সাদীর ছোট ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের একুশে পদক প্রাপ্তি। ছোট ভাইয়ের কর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বড় ভাই সাদীকে আনন্দ দিলেও স্বীকৃতি প্রদানের অনুষ্ঠানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। নিজের না পাওয়ার হতাশা লুকিয়ে ছোট ভাইকে বলেছেন ‘তুই পেলেই আমার পাওয়া হবে’।
পদক পেতে নাকি সরকারের আপনজন হতে হয়, তদবিরের জোর থাকতে হয়। তাই বোধ হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শর্ষিনার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফরকে ১৯৮০ সালে ‘স্বাধীনতা’ পুরস্কার দেওয়া হয়। একইভাবে দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত খন্দকার আব্দুল হামিদকেও ১৯৭৭ সালে সাংবাদিকতায় ‘একুশে পদক’ দেওয়া হয়েছে। এমন অনেকের গলাতেই ‘স্বাধীনতা’ পদক তুলে দেওয়া হয়েছে যাদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো যোগ ছিল না। বিতর্ক আরও আছে, সব সরকারের আমলেই নিজের কাছের লোককে ‘একুশে’ এবং ‘স্বাধীনতা’ পদক তুলে দিয়ে ভাষা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা হয়েছে।
এ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পদকের জন্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের প্রক্রিয়াটিও যথাযথ বলে মনে হয় না। আবেদন করে পদক নেয়ার আগ্রহ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অনেকের থাকে না। সাদীর পরিবারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক খারাপ; তা কিন্তু বলা যাবে না। তাহলে সাদী কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না? স্বাধীনতার উষালগ্নে তাদের পরিবারের অবদান কম ছিল না। সাদীর বাবা ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিনেই শহীদ হন মহম্মদ সলিমুল্লাহ। কবর দেয়ার জন্য তার মৃত দেহটিও পাওয়া যায়নি। অবশ্য তার নামেই মোহাম্মদপুরে সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে সাদীদের বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। সাদীর বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শেখ কামাল। শেখ কামাল, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম জিকু, শাহজাহান সিরাজসহ বড় বড় নেতাদের প্রায়ই তাদের বাসায় আগমন হতো।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগের উল্লিখিত নেতারা সাদীদের বাসায় উপস্থিত হয়েছিলেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান সাদীর বাবা মহম্মদ সলিমউল্লাহ, আর সেই পতাকা সাদীর করা নক্সায় সেলাই করে দিয়েছিলেন সাদী মহাম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ। এতে প্রতিপন্ন হয়, মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারের অবদান রয়েছে; এবং তারা বর্তমান সরকারের অপরিচিত কেউ নন। গানের জগতে সাদী মহম্মদের যতটুকু অবদান রয়েছে, তা দিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হলে অন্তত কটু-সমালোচনা হতো না। জনগণ খুশি হতো। পদক প্রদানে মানুষের কর্ম জীবিত থাকার সময় বিবেচনায় না এনে মৃত্যুর পর কেন বিবেচিত হয়, তা স্পষ্ট নয়। নোবেল পুরস্কার তাই কোনো মৃত ব্যক্তিকে দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে অনেকেই একাধিক রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন। অনেকে বাংলা একাডেমি, একুশে পদক পাওয়ার পরও স্বাধীনতা পদক না পেয়ে মরতে চাননি। পেয়েছেনও; কিন্তু কেন? দেশে পদক পাওয়ার যোগ্য লোকের এত আকাল পড়ল কেন? মুক্তিযুদ্ধে কোটি কোটি লোকের অবদান রয়েছে, তাদের বিবেচনায় না নিয়ে একই ব্যক্তিকে সব পদকে ভূষিত করার এই মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যজ্য। এতে প্রকাশ পায় জাতির দেউলিয়াত্ব।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাদীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমানজাত হতাশাকে উল্লেখ করায় অনেক শিল্পীর আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে। তারা বলতে চাচ্ছেন- প্রকৃত শিল্পী কখনো প্রাপ্তি, অর্জন, পদকের লোভে সাধনা করেন না। তারা আরও একটি কথা এখন উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। তা হলো, সাদীর মৃত্যুর পর পদক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি সাদীকে ছোট করছে। আমরা আমজনতা তা মনে করি না। প্রায় সবাই সাদী মহম্মদের পক্ষে বলছেন, সাদী যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত ছিলেন, তা সবার লেখায় প্রতিফলিত হচ্ছে। যারা যথার্থ শিল্পী তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কোনো করুণা নয়। কর্মের সম্মান। রাষ্ট্রকে ভুল শোধরানোর জন্য সবার আরও বেশি সোচ্চার হতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও মহান এই সংগীত সাধককে সশ্রদ্ধচিত্তে বিদায় জানিয়েছেন কোটি কোটি ভক্ত। মরণোত্তর পদক দিয়ে তাকে আর যেন দ্বিতীয়বার অপমান না করা হয়। অগণিত মানুষের ভালোবাসা, দেশ-বিদেশে হাজার হাজার ভক্তের ভালোবাসায় শিল্পী সাদী মহম্মদ বেঁচে থাকবেন বহুকাল।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে