বিশেষ সংখ্যা : মোনাজাতউদ্দিন
অবিস্মরণীয় সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন: সশ্রদ্ধ অভিবাদন
সাংবাদিকতা একটি মহত্তম পেশা। দেশ আর সমাজের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সাংবাদিকসমাজ, এই আপ্তবাক্য কমবেশি সবারই জানা; কিন্তু মহৎ, আদর্শবাদী, নিঃস্বার্থ একজন মানবপ্রেমী সাংবাদিক কালের বিবর্তনে আজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই দুর্লভ প্রায় আদর্শবাদী সাংবাদিকের দৃষ্টান্ত দিতে গেলে আমাদের প্রজন্মের কাছে প্রথমেই মনে আসে মোনাজাতউদ্দিনের নাম।
আজকের তরুণ প্রজন্ম মোনাজাতউদ্দিনের নাম এবং সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের কথা কতটা জানেন, জানি না। আমাদের প্রজন্ম আমরা যখন এই পেশায় ঢুকেছিলাম (১৯৭৬) তখন মোনাজাতউদ্দিন সাংবাদিক হিসেবে তৃণমূল মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত এক জ্বলন্ত নাম। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত পশ্চাদপদ, উত্তরাঞ্চলের একটি জনপদে থেকে একজন সংবাদকর্মী তার পেশাগত দক্ষতায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পরিচিতি অর্জন করতে পারবেন, এটা সহজ কথা নয়।
পরিচিতি বললে ভুল হবে, বলতে হয় তারকাখ্যাতিই অর্জন করেছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। স্বাধীনতা পূর্বকালেই অতি তরুণ বয়সে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। প্রথমে স্থানীয় পত্রিকায়, পরে ঢাকার একাধিক কাগজে। তবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রগতিশীল দৈনিক সংবাদে। দৈনিক জনকণ্ঠে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। সে হিসেবে তিনি আমার সহকর্মীও।
দৈনিক জনকণ্ঠে বেশি দিন কাজ করতে পারেননি তিনি। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যমুনায় ফেরি থেকে নদীতে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারান তিনি। প্রায় তিনটি দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেল, অথচ তার মৃত্যুর রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হলো না! কেন না তার নদীতে পড়ে যাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল তখনই। তৎকালীন সরকার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল; কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি।
তার মৃত্যু স্বাভাবিক না কি অস্বাভাবিক এ প্রশ্ন তোলা বা সন্দেহের যৌক্তিক কারণও উড়িয়ে দেয়া যায় না। শুরু থেকেই ছিলেন অধিকার বঞ্চিত মানুষের পক্ষে গণমুখী একজন পেশাদার লড়াকু সাংবাদিক। তার সাংবাদিকতায় যাদের স্বার্থহানি ঘটেছে, এ কারণেই তারা ছিলেন তার বিরুদ্ধে। সমাজের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রশাসনের কোনোরকম রক্তচক্ষুকে কোনোদিন তোয়াক্কা করেননি মোনাজাতউদ্দিন। আজীবন ব্যক্তিগত লাভ আর লোভের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন পেশার মর্যাদাকে। যে জন্য অর্থনৈতিক সংকটে অতি সাধারণ জীবনযাপন করেও তিনি ছিলেন অসাধারণ এক ঐশর্যবান ব্যক্তিত্ব।
বহুকাল ধরে রাজধানী ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন আর চরম অভাবগ্রস্ত তৎকালীন রংপুরের প্রত্যন্ত জনপদের সাধারণ মানুষকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক; কিন্তু আমাদের জন্য লজ্জার বিষয় এই গৌরবময় পুরস্কারটি তিনি নিজে গ্রহণ করতে পারেননি, তাকে দেয়া হয় মরণোত্তর স্বীকৃতি।
সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা আছে, আছে তার সৃষ্টিশীল কিছু সাহিত্যকর্মও। কেননা মোনাজাতউদ্দিনের সাহিত্যচর্চা আর সাংবাদিকতা প্রায় একই সমান্তরালে। সাহিত্য সূত্রেই তাকে আমি প্রথম দেখি সংবাদ এর খেলা ঘরের পাতায়। চাক্ষুষ দেখার আগে তার ছড়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি তখন কাজ করি ৯১ নবাবপুর রোড থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক গণমুক্তি পত্রিকায় সংবাদের অফিস এবং খেলাঘর তখন বংশালে।
সাহিত্যসভায় যেতাম বংশালে, পরে পুরানা পল্টনে। সংবাদ অফিস বংশালে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে দেখা, পরিচয়। গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে ঘুরে ঘুরে ঝড়-বৃষ্টি, দাবদাহ উপেক্ষা করে তিনি কত কঠোর পরিশ্রম করে একেকটা সাড়া জাগানো রিপোর্ট তৈরি করতেন, ঢাকার গণমাধ্যম অঙ্গনে ছাড়িয়ে সেটা ছিল চায়ের টেবিল থেকে সরকারি অফিস পর্যন্ত আলোচিত বিষয়।
গ্রামীণ সাংবাদিকতায় তার অগ্রণী অনেকেই ছিলেন। মুন্সীগঞ্জের শফিউদ্দিন সাহেবের মতো নিবেদিত প্রাণ সৎ প্রবীণরাও ছিলেন; কিন্তু গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃতের সম্মানজনক উপাধিটা পেয়েছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে তিনি এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিলেন। এলাকায় মন্ত্রী গেছেন, মন্ত্রীর সংবাদ সংগ্রহের জন্য তোষামোদির জন্য যাওয়ার চেয়ে যদি একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট তৈরির জন্য শহর ছেড়ে দূরের গ্রামে যেতে হতো চলে যেতেন মোনাজাতউদ্দিন।
মন্ত্রীর সংবাদটি ছাপতে হতো সার্ভিস থেকে। মাত্র ৫০ বছরের জীবনে (১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ১৯৯৫-এর ২৯ ডিসেম্বর) সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন, তা অবিস্মরণীয়ই বলতে হবে। সরেজমিন ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করে তা জাতীয় দৈনিকে প্রকাশের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে চারণ সাংবাদিকখ্যাত মোনাজাত উদ্দীনের যে অবদান তা অতুলনীয়। তার সংবাদের সঙ্গে পরিবেশিত আলোকচিত্র তিনি নিজেই গ্রহণ করতেন। সেসব আলোকচিত্র দেখে বিস্মিত হতেন ঢাকার ফটো সাংবাদিকরা।
বসবাস করেছেন গ্রামীণ জনপদে, মিশেছেন যাদের সঙ্গে, তাদের অধিকাংশই তৃণমূল পর্যায়ের অতি সাধারণ মানুষ; কিন্তু মোনাজাত মনোজগতে লালন করতেন একজন আধুনিক স্মার্ট ব্যক্তিকে, যিনি তার লেখাকে সমৃদ্ধ করেছেন, জীবনযাপনে পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ টিকিয়ে রেখেছেন এবং তার সৃজনশীল সাহিত্যকে আধুনিক পাঠকের উপযোগীও করেছেন। সে কারণেই লেখক হিসেবেও সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন সচেতন পাঠকমনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। তার লেখালেখির মূল প্রেরণা মূলত তৃণমূলের সাধারণ মানুষ। তার রিপোর্টিংয়ের নেপথ্য কাহিনিজুড়ে আছে গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ।
‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনি’, ‘পথ থেকে পথে’, ‘কানসোনার মুখ ও সংবাদ নেপথ্যে’, ‘পায়রাবন্দ শেকড় সংবাদ’ এসব বইয়ের দৃষ্টান্ত। সাংবাদিকতা আর সাহিত্যকে একই বৃন্তে ফুল আর পাতার সমান্তরালে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ‘কানসোনার মুখ’ বইটি তিনি আমাকে স্বাক্ষর করে উপহার দিয়েছিলেন। জনকণ্ঠের সাময়িকী পাতার দায়িত্বে থাকাকালে যতদূর মনে পড়ে দু-একটি বইয়ের পরিচিতিমূলক আলোচনাও ছাপার ব্যবস্থা করেছিলাম।
জনকণ্ঠের কথা যখন এলোই, এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে তাকে নিয়োগের বিষয়টি। অনেক দিনের কর্মস্থল সংবাদে কাজ করছেন তিনি। একদিন সম্পাদকীয় মিটিংয়ে শ্রদ্ধেয় তোয়াব খান (জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক) আমাদের জানালেন তিনি মোনাজাতউদ্দিনকে জনকণ্ঠে নিয়োগ করতে চান। সিটি এডিটর, নিউজ এডিটরসহ অন্যদের সঙ্গে আজই এ ব্যাপারে তার কথা হয়েছে তাও জানালেন। আমাদের মতামত জানতে চাওয়া হলে এ টি এম শামসুদ্দিন ভাই, শুভ রহমান, কবি ইউসুফ পাশাসহ আমরা সবাই তার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানলাম। তখনই তোয়াব ভাই মোনাজাতউদ্দিনের সংবাদের প্রকাশিত কিছু সাড়াজাগানো রিপোর্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।
তোয়াব খানের পঠন পাঠন ছিল ব্যাপক। কি ভারতবর্ষ কি বাংলাদেশ, যেখানে যা কিছু ভালো লেখা, যার অধিকাংশই কেমন করে জেনে তিনি পড়ে ফেলবেন। এমন সব বইয়ের কথা আমাদের সম্পাদকীয় মিটিংয়ে আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে বলতেন, আমরা অবাক হয়ে যেতাম। বিশেষ করে আমি বাংলা সাহিত্যে পড়া মানুষ, কবি ইউসুফ পাশা বাংলা সাহিত্যের ছাত্র , নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এসব উপন্যাস পড়িনি। সেই পঠন-পাঠনের পিপাসা থেকে তিনি ঢাকার দৈনিকগুলোতে যে কোনো ভালো রিপোর্ট বের হলে সবার আগে আমাদের সঙ্গে সেগুলো নিয়ে কথা বলতেন। সংগত কারণেই আমাদের চেয়ে বেশি জানা হয়ে গিয়েছিল তার সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে।
এ আলোচনার প্রায় মাস দেড়েক পরে একদিন মোনাজাতউদ্দিন অফিসে এলেন এবং যোগদানের পর আমাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন নতুন করে। আমাদের দুর্ভাগ্য তাকে বেশি দিন পেলাম না। উত্তরবঙ্গের রিপোর্টিংয়ের ভার তার ওপর ছেড়ে দিয়ে তোয়াব ভাই খুব নিশ্চিন্ত ছিলেন। তার মৃত্যু জনকণ্ঠের জন্য বিশেষ গুরুত্বের। আমাদের সবার মনে এক বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করল। তার মৃত্যুর পর বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন তিনি। মোনাজাতউদ্দিন যোগদান করে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তার মধ্যে সেই পরিতৃপ্তি আমরা দেখেছি।
সাংবাদিকতায় আদর্শবাদী এবং নিরঙ্কুশ সততার জন্য মোনাজাতউদ্দিন আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিরল সম্মানে। এ কারণে যে অনেকের সুযোগ পায় না বলে ঘুষ খায় না আর মোনাজাতউদ্দিনের মতো মানুষ অসংখ্য প্রলোভন এবং আহ্বান উপেক্ষা করেছেন লোভের পশুকে নিজ হাতে বলি দিয়ে। এই সল্পপরিসর লেখায় তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে মূল্যায়ন করা গেল না। ছড়া, কবিতা আর গল্প, রিপোর্টিংয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার পেছনের ঘটনা ইত্যাদি নিয়েও তিনি যে সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করেছেন, তার মধ্যে নাটকও ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। যদিও তার একটিমাত্র নাট্যগ্রন্থ কিন্তু নাটক-অন্তপ্রাণ মোনাজাত মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন, মঞ্চের জন্য পাণ্ডুলিপিও রচনা করেছেন।
১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাটে সংবাদ সংগ্রহের সময় ফেরি থেকে পড়ে গিয়ে চিরতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেছেন মোনাজাতউদ্দিন। মাত্র ৫০ বছর বয়সে তার মতো সাংবাদিকের চলে যাওয়া আমাদের সাংবাদিকতা জগতের জন্য ছিল অপূরণীয় ক্ষতির ঘটনা। আমরা কেবল সেই ক্ষতিপূরণ করতে পারি সাংবাদিকতায় মোনাজাতউদ্দিনের আদর্শ তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে এনে আমাদের অবক্ষয়কবলিত প্রাঙ্গণকে পরিশীলনের মাধ্যমে।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে