সান্ডা গিরগিটি: মরুভূমির বিস্ময়কর বাসিন্দা, ওষুধ নাকি গুজব?
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এক অদ্ভুত প্রাণী — সান্ডা গিরগিটি। "সান্ডা খাওয়া" নিয়ে মেমে, ভিডিও ও আলোচনায় ভরে উঠেছে ফেসবুক-ইউটিউব। কিন্তু এই গিরগিটির আসল পরিচয় কী? কেন একে ঘিরে এত আলোচনা?
সান্ডা গিরগিটি, যার বৈজ্ঞানিক নাম Saara hardwickii, দক্ষিণ এশিয়ার মরুভূমিতে বসবাসকারী এক বিস্ময়কর প্রজাতি। ভারতের থার মরুভূমি ও কচ্ছ, আর পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের কোহিস্তান এলাকায় এদের দেখা মেলে। বালির চেয়ে শক্ত মাটি পছন্দ করা এই গিরগিটি উপরে থেকে সাধারণ হলেও এর গুরুত্ব সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক—তিনটি ক্ষেত্রেই।
মরুভূমির ইকো-হিরো
সান্ডা গিরগিটি ২ মিটার পর্যন্ত লম্বা গর্ত খুঁড়ে বসবাস করে এবং উপনিবেশিকভাবে (একসাথে অনেক গিরগিটি) জীবনযাপন করে। এদের গর্তগুলোতে শিকার করে বাজপাখি, ঈগল, মরু শিয়াল, ও সাপ—তাই এটি মরুভূমির খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
খাবার ও ঔষধি বিশ্বাস
ভারত ও পাকিস্তানে কিছু সম্প্রদায় সান্ডা গিরগিটির মাংস খায়, বিশেষ করে লেজের মাংসকে তারা সুস্বাদু ও শক্তিদায়ক বলে মনে করে। তবে এর চর্বি থেকে তৈরি "সান্ডা তেল" বেশি জনপ্রিয়—যা লোকচিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় যৌন দুর্বলতা, জয়েন্টের ব্যথা, ও পেশির ব্যথার জন্য।
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির রজা বাজারে এ তেল খোলামেলা বিক্রি হয়, এবং ইউএই ও ওমানে রপ্তানি হয় বলে প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। ইউটিউব ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বেআইনি বিক্রি বেড়েই চলেছে।
ইসলাম ধর্মে সান্ডা খাওয়া কি বৈধ?
একটি হাদীস অনুযায়ী, রাসূল (সা.)-কে একবার সান্ডা (সম্ভবত ধাব প্রজাতির) গিরগিটি খেতে দেওয়া হয়েছিল, তিনি নিজে না খেলেও হারাম বলেননি। সাহাবি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) তার সামনে খেয়েছেন।
এই হাদীসের ভিত্তিতে অধিকাংশ ইসলামি পণ্ডিত, যেমন ইবন কুদামা, একে হালাল মনে করেন। তবে কিছু হানাফি মতাবলম্বী, যেমন ইমাম আবু হানিফা, বিরত থাকার পরামর্শ দেন। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক মুসলিম সম্প্রদায় এই গিরগিটি খায় এবং হালাল হিসেবে গ্রহণ করে।
সংকটাপন্ন প্রজাতি
চাহিদা এতটাই বেশি যে, ভারতের রাজস্থান অঞ্চলে এ গিরগিটির সংখ্যা বিপজ্জনক হারে কমে যাচ্ছে। ভারতের বন্যপ্রাণী আইন, ১৯৭২ অনুযায়ী সান্ডা গিরগিটি এখন "Schedule I" প্রজাতি, অর্থাৎ সর্বোচ্চ আইনগত সুরক্ষা পাচ্ছে। IUCN (International Union for Conservation of Nature) একে "Vulnerable" বা সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সৌদি আরবের প্রেক্ষাপটে
সৌদি আরবে সান্ডা গিরগিটি স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় না। তবে "ধাব" প্রজাতির গিরগিটি শিকার করা হয়। যেহেতু সান্ডা গিরগিটি CITES Appendix II-তে তালিকাভুক্ত, তাই এর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুধুমাত্র অনুমোদিত লাইসেন্স থাকলে বৈধ। সৌদিতে অবৈধ আমদানি করলে ৩ কোটি সৌদি রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা বা ১০ বছরের জেল হতে পারে।
সান্ডা গিরগিটি শুধু একটি প্রাণী নয়—এটি মরুভূমির এক জীবন্ত প্রতীক। এর মাংস ও তেল কিছু জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য ও ওষুধ, আবার অন্যদের কাছে রহস্যময়। তবে বিজ্ঞানের ভাষায়, এর অধিকাংশ গুণের এখনো পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।
এই প্রজাতিকে রক্ষা করা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, একটি পরিমিত ও যুক্তিভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্যও জরুরি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে