নিজেকে একান্তভাবে সময় না দিলে, সৃজনশীলতা কিংবা বোধের বিকাশ প্রায় অসম্ভব
এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কবি সৌম্য সালেকের প্রবন্ধের বই ‘বিংশ একবিংশ’। তার লক্ষ্য হচ্ছে কিছু চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনা করা। ফলে ‘বিংশ একবিংশ’ বইটিতে মূলত তিনি মন্ময় তথা চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনার প্রস্তুতি হিসেবে বেশকিছু আলোচনাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের মাহফুজ সরদার।
ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের বইমেলায় আপনার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বিংশ একবিংশ’ প্রকাশিত হয়েছে, এই বই নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই?
সৌম্য সালেক: ‘বিংশ একবিংশ’ একুশটি রচনার সংকলন। এখানে বিশ-শতকের মনীষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং প্রবণতা নিয়ে আলোচনা রয়েছে এবং একুশ শতকে এসে যোগাযোগ-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে মানুষের জীবনে যে উদ্দাম গতি এসেছে, তাও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর প্রযুক্তিগত প্রসারের ফলে যে প্রতিঘাত নেমেছে মানুষের জীবনে সেদিক সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। এ বই নিয়ে পাঠকদের প্রতি আমার কথা হচ্ছে, কবিতা বা শিল্পের অবগাহনে হৃদয়ে যে স্ফূর্তি জেগেছে, তা সে কবি ও শিল্পীর কাছে কিংবা শিল্পীপ্রেমীদের কাছে লোকে লোকে শুনিয়ে আসার অবকাশ নেই তাই রচনার আঙ্গিকে উন্মুক্তভাবে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছি। শিল্পবোধের সঞ্চার, চিত্তবৃত্তি, যুগ-বিশ্লেষণ কিংবা মানবতার কল্যাণের স্বার্থে এসব বক্তব্য যদি কালে কালে হাতে গোনা কয়েকজন হৃদয়বাদী মানুষকেও আকর্ষণ করে, তবে শ্রম সার্থক হয়েছে বলে তৃপ্তি পাব।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনায় মনোযোগী হয়েছেন এর কারণ কী?
সৌম্য সালেক: এর কারণ কিছুটা ওপরে বলে দিয়েছি; এ ছাড়া, শিল্পকলা কিংবা সামাজিক যে কোনো পরিপ্রেক্ষিতে হৃদয়ের উপলব্ধিটুকু জানান দেয়া। এটা প্রয়োজনীয়, কেননা একেকটা শিল্পসম্পর্কে একেকজনের ব্যাখ্যা (Interpretation) একেক রকম। এ কাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ আলী আহসানসহ আরও অনেক সৃজনশীল লেখক করেছেন। আরেকটি বিষয়, গভীর চিন্তা বা অভিনব ডিসকোর্স (Discourse) প্রকাশের জন্য রচনার বিকল্প নেই। জীবন ও শিল্পসম্পর্কে আমার ধারণা বা বক্তব্য প্রকাশের জন্যই মূলত রচনা লিখছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সমালোচনা কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন? সমালোচনা কেমন হওয়া উচিত?
সৌম্য সালেক: সমালোচনা আমাদের এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় স্তুতি বা নিন্দামূলক কিন্তু সমালোচনা হওয়া দরকার বিশ্লেষণমূলক এখানে শত্রু-মিত্র বোধ-বিবেচনা না করাই শ্রেয়। ইংরেজি কিংবা ফরাসি সাহিত্যে সমালোচনার শক্তিশালী ধারা বিদ্যমান, বাংলাসাহিত্য সেভাবে সমালোচনা সাহিত্য বিকাশ লাভ করেনি। আমি আসলে মন্ময় তথা চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচনার প্রস্তুতি হিসেবে বেশকিছু আলোচনাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছি। আমার লক্ষ্য চিন্তামূলক কিছু প্রবন্ধ লেখা যেমন, ‘মানুষের ধর্ম গ্রন্থে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ লিখেছেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলা সাহিত্য এখন কেমন সময় পার করছে?
সৌম্য সালেক: এ প্রশ্নের উত্তর আসলে অনেক বিস্তারিত, দুকথায় এর উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। লেখা তো অনেক বেরুচ্ছে; কিন্তু গভীর ছাপ ফেলার মতো ধ্রুপদি কোনো কাব্য বা উপন্যাস গত পনেরো বছরে আমার চোখে পড়েনি। এটা একটা সংকটের কথা। ‘সোনালী কাবিন’ কিংবা ‘রক্তগোলাপ’ পড়ে আমরা যেমন বলতে পারি এ দুটি মহৎ কাব্য ও উপন্যাস তেমন রচনা আমরা সম্প্রতি পাচ্ছি না। হয়তো এমন মহৎ কিছু এর মধ্যে হয়েছে কিন্তু আমাদের পাঠে আসেনি।
ভিউজ বাংলাদেশ: দুই বাংলার সাহিত্যের মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
সৌম্য সালেক: পশ্চিম বাংলার একটি বড় সমস্যা মনে হচ্ছে, তারা হিন্দি আর ইংরেজির দাপটের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা ঠিকঠাক বজায় রাখতে পারছে না। দিন দিন সেখানে বাংলা প্রকাশনা ও কাগজের সংখ্যা কমছে। এদিকে বাংলাদেশ বাংলাচর্চায় আরও বেশি অগ্রসর হয়েছে এবং ঢাকা হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষার কেন্দ্র। তবে আমাদের এখানে ভাষা-সাহিত্যচর্চায় যত্ন ও পেশাদারিত্বের অভাব লক্ষ্যণীয়, ভাষা প্রসারের স্বার্থে যেটা খুব জরুরি।
ভিউজ বাংলাদেশ: অনলাইন এসে পাঠকের সংখ্যা কি বেড়েছে নাকি কমেছে, এর কারণ কী?
সৌম্য সালেক: পাঠক বলতে এখন আপনি যদি ফেসবুকের দুবাক্যের মন্তব্য-পাঠককে বুঝান তাহলে বলতে হবে বেড়েছে; কিন্তু তারা যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে এগোয় তাকে পাঠ বলা যাবে কি না, সন্দেহ আছে; কিন্তু আপনি দেখেন প্রকৃত সাহিত্য পাঠক এখন খুবই কম। যাও কজন আছেন গল্প-উপন্যাসের পাঠক, গভীর জীবনবোধের প্রকাশ যেখানে তেমন রচনার পাঠক নেই বললেই চলে। এর বড় কারণ বোধ হয় জীবন যন্ত্রণা ও মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম। আরেকটি কারণ কোথাও কোনো উদ্ভাবন ঘটলে বাছবিচার না করে দ্রুত সেটা লুফে নেয়া অর্থাৎ হুজুগে ভাব। নিজেকে একান্তভাবে সময় না দিলে, সৃজনশীলতা কিংবা বোধের বিকাশ ঘটা প্রায় অসম্ভব। নিজের দিকে তাকানো দরকার, সে সময়টা মনে হচ্ছে নতুন প্রজন্মের হাতে নেই কিংবা এ বিষয়ে তাদের চিন্তার অভাব।
ভিউজ বাংলাদেশ: নিয়মিত পাঠ অভ্যাস লেখকদের জন্য কতটা জরুরি?
সৌম্য সালেক: আমি মনে করি, একজন প্রকৃত লেখকের কাজ চারটি: ভাবনা, ভ্রমণ, পঠন-পাঠন এবং লিখন। পাঠ তো অবশ্যই জরুরি, একটি পাঠ আপনার ভেতরে এক বা একাধিক নতুন ভাবনার সঞ্চার ঘটাবে। না পড়লে তো তাকে লেখকই বলা কঠিন।
ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের বইমেলা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
সৌম্য সালেক: বইমেলার পরিবেশ তো গতানুগতিক তবে এবারের লিটলম্যাগ চত্বর আমার কাছে দৃষ্টিনন্দন মনে হয়েছে যদিও ছোট কাগজের নতুন সংখ্যা কম এসেছে এবার। একটি বিষয় দৃষ্টিকটু, মেলায় প্রতিদিন প্রচুর হকার ও খুচরা বিক্রেতা ঢুকছে, এটা মোটেও মেলার জন্য শোভন নয় এসব নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি মনে করছি। একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর মেলা বসেছে, অন্য সব অঙ্গনে যেমন উৎকণ্ঠা রয়েছে, কবি-লেখকদের মধ্যেও তার প্রভাব থাকা স্বাভাবিক।
ভিউজ বাংলাদেশ: সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে কি বলবেন
সৌম্য সালেক: সাহিত্য পুরস্কার তো একটি ইতিবাচক প্রক্রিয়া কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা পুরস্কারের অর্থকেই যেন নেতিবাচক করে ফেলেছে। এখন এমন দাঁড়িয়েছে অবস্থা পুরস্কার দিতে চাইলেও অনেকে গ্রহণ করবে না। এ বিষয়ে কথা বলাটাও কেমন অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছে। তবে অবশ্যই পুরস্কারদাতাদের চূড়ান্ত করার আগেই ভাবা উচিত কাকে দিচ্ছি, সে সার্বিকভাবে উপযুক্ত কি না এবং গ্রহিতাকেও বুঝে-শুনে সম্মতি দেয়া উচিত সে নেবে কি না, তাহলে অন্তত বাজে পরিস্থিতি তৈরি হবে না। সর্বোপরি আমি এটা বলতে পারি যে, একজন সৃষ্টিশীল লেখক যে কোনো পুরস্কারের চেয়ে বড়, যেমন: আমি লিও তলস্তয় এবং কহলিল জিবরানকে নোবেল পুরস্কারের চেয়েও হাজার গুণ মহৎ মনে করি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে