Views Bangladesh Logo

অনুভবে অনুধ্যানে সত্যজিৎ রায়

“ওরা যত বেশি পড়ে, ততো বেশি জানে, ততো কম মানে” — সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ছবিতে হীরক রাজার মুখে উচ্চারিত এই বাক্য যেন সত্যজিতের নিজের জীবনকেও প্রতিফলিত করে। কারণ, তিনি যত বেশি পড়েছেন, দেখেছেন, জেনেছেন, ততই ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যা তাঁকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে। হয়ে উঠেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি। আজ এই কিংবদন্তির জন্মদিন।

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সাথে আমার পরিচয় হয় ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমার মাধ্যমে। তখন সালটা ছিল ২০১৫৷ বাবা আর আপুর সাথে বসে সিনেমাটা দেখেছিলাম। তখনো সিনেমা নিয়ে আমার তেমন জ্ঞান হয়নি( এখনো হয়নি)।

তবে মনে আছে এরপর মাথায় ভূত চেপেছিল তার সব সিনেমা দেখবো বলে। কিন্তু সোনার কেল্লা, অপরাজিত, অপুর সংসার দেখার পর আর কোনো সিনেমা তেমন দেখা হয়নি। এরপর দীর্ঘসময় পর সত্যজিৎ রায়কে বিস্তরভাবে জানার সুযোগ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। ক্লাসে একজন শিক্ষক কথায় কথায় গুণী এই নির্মাতার নাম বলতেন। তখন বলা যায় অনেকটা ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত আগ্রহ নিয়ে দেখা শুরু করলাম একে একে সত্যজিৎ রায়ের সব সিনেমা। সেই শুরু এরপর এই নির্মাতার সম্বন্ধে যত জেনেছি ততো অবাক হয়েছি। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কিছু লেখার যোগ্যতা আমার নেই, তবু আজকে তাঁর জন্মদিনে তাকে নিয়ে আনাড়ি হাতে কিছু লিখতে বসলাম দেখি পারি কি না!

বাংলা সিনেমাকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সত্যজিৎ রায় আজকের দিনে কলকাতার বিখ্যাত রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বাবা সুকুমার রায় বিখ্যাত শিশুসাহিত্যক হলেও সত্যজিৎ রায় ছিলেন তাদের থেকে ভিন্ন। যদিও তিনি শিশুদের জন্য গোয়েন্দা গল্প ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু লিখেছেন তবু তিনি বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই পরিচিত।


তবে সত্যজিৎ রায় শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতাই ছিলেন না, একাধারে তিনি ছিলেন চিত্রনাট্যকার, সংগীত পরিচালক, গ্রাফিক নকশাবিদ, চলচ্চিত্র সমালোচক এবং লেখক। সত্যজিৎ তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে জুনিয়র ভিজ্যুয়ালাইজার হিসেবে। এই কাজে তিনি ছিলেন অসমান্য দক্ষ। এরপর তিনি সিগনেট প্রেসে বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করার দায়িত্ব নেন। সেখানে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী বইয়ের শিশুতোষ সংস্করণ ‘আম আটির ভেঁপু’ বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করার। তখন থেকেই এই বইয়ের কাহিনি তার মনে গেঁথে যায়। ১৯৫০ সালে চাকরিসূত্রে তিনি লন্ডন যান৷ সেখানে ছয় মাসে তিনি প্রায় ৯৯ খানা সিনেমা দেখেন। তার মধ্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে ভিট্টোরিয়া ডি সিকার এর ‘বাইসাইকেল থিভস’। এই সিনেমা দেখার পর তিনি মনঃস্থির করেন পথের পাঁচালী নির্মাণ করবেন। লন্ডন থেকে ফেরার পথে জাহাজে বসেই পথের পাচালীর চিত্রনাট্যের একটা খসড়া লিখেন। এরপর শুরু হয় সিনেমার জন্য প্রযোজক খোঁজা। কিন্তু কেউ চিত্রনাট্যটা তেমন পছন্দ করলো না। তারপর নিজ উদ্যোগেই সত্যজিৎ রায় ১৯৫২ সিনেমা নির্মাণের কাজ শুরু করলেন। একটা কথা না বললেই নয় সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন সহধর্মিণী বিজয়া রায়। যাকে সত্যজিৎ রায় মঙ্কু বলে ডাকতেন। সিনেমাটি তৈরি করতে গিয়ে আর্থিক সংকট দেখা দিলে বিজয়া রায় নিজের গয়না বন্ধক রেখেছিলেন।


তবু আর্থিক সংকটের কারণে প্রায় তিনবছর নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকে। এরপর সরকারি অর্থায়নে সিনেমার কাজ শেষ হয় এবং অবশেষে মুক্তি পায় বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সিনেমা পথের পাঁচালী। শুরুতেই সিনেমাটি কলকাতায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর ১৯৫৬ সালে ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে নির্বাচিত হয়। সেই শুরু এরপর একের পর এক নির্মাণ করেছেন কালজয়ী সব সিনেমা৷ পথের পাঁচালীর পর নির্মাণ করলেন অপরাজিতা, যা ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার পায়। তারপর নির্মাণ করেন কাঞ্চনজঙ্ঘা, অভিযান, মহানগর, চারুলতা, নায়ক, গুপী ঘাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, আগুন্তক, অশনি সংকেতের মতো চলচ্চিত্র৷ চারুলতা সিনেমাতে তিনি দেখিয়েছেন গল্পের প্রধান চরিত্র চারুর নিঃসঙ্গতা এবং স্বামী ভূপতির সাথে চারুর দূরত্ব। আর নায়ক সিনেমাতে দেখিয়েছেন সিনেমার পর্দার আড়ালে বাস্তবজীবনের একজন নায়কের নিঃসঙ্গতাময় জীবন, হতাশা আর দ্বন্দ্ব। আবার হীরক রাজার দেশে নির্মাণ করেছেন তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশকে ব্যঙ্গ করে। বর্তমান সময় চিন্তা করলে এই সিনেমার প্রত্যেকটি ডায়ালগ এবং চরিত্র এখনো প্রাসঙ্গিক। সত্যজিৎ তার প্রত্যেক ছবিতেই নিজের সৃষ্টি করা সঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন। ওয়েস এন্ডারসন তার ‘দ্য দার্জিলিং লিমিটেড’ সিনেমাতে সত্যজিতের তৈরি করা সঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন।

সত্যজিত রায় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন যা। তিনটি চলচ্চিত্র হলো ‘প্রতিদ্বন্দী’, ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জন অরণ্য। এই তিনটিকে একসাথে কলকাতা ট্রিলোজি বলে। সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন টালমাটাল ছিল তখন এ চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায়।

সত্যজিত রায়ের সিনেমা দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন ইরাকের আব্বাস কিয়ারোস্তামি, আমেরিকার মার্টিন স্করসেজি এবং ফ্রান্সের জ লুক গদার। তবে সত্যজিতকে সিনেমা নির্মাণে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিলেন ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়া। যার কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।

সত্যজিত রায় জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ৬ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। ১৯৯২ সালে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে তাকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সত্যজিত রায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও এখনো তিনি তাঁর সৃষ্টির জন্য অমর হয়ে রয়েছেন। সৃজনশীল, শৈল্পিক সব সৃষ্টির জন্য আজ তাঁর জন্মদিনে তাকে কুর্নিশ জানাই!

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ