Views Bangladesh Logo

মেরিন ড্রাইভের আতঙ্ক: ভাড়ার বাইকে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি

Esmat Ara Issu

ইসমত আরা ইসু

ক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে অনুমোদনহীন রেন্ট-এ-বাইকের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটারের এই সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিও। রেন্ট-এ বাইক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং হেলমেট ছাড়াই পর্যটকদের বাইক চালানোর প্রবণতাকে এ জন্য দায়ী করছেন স্থানীয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, মেরিন ড্রাইভে দিনে গড়ে ১২-১৩টি বাইক দুর্ঘটনার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। গত কয়েক বছরে এই সড়কেই প্রাণ গেছে অর্ধশতাধিক মানুষের। দ্রুত এসব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন পর্যটকরাও।

সরেজমিন অভিযোগ পাওয়া গেছে, শহরের কলাতলী হয়ে মেরিন ড্রাইভের শুরুর অংশ বেলি হ্যাচারিসহ মোড়ে মোড়ে অবৈধভাবে অসংখ্য মোটরসাইকেল ভাড়া দেয়া হচ্ছে। সামনেই পুলিশবক্স থাকলেও মানা হচ্ছে না কোনো আইনি শর্তই। তবে, যথাযথ অনুমোদনহীন এসব রেন্ট বাইক ব্যবসায়ীর দাবি, পর্যটকদের চাহিদা মেটাতেই তারা এই ব্যবসা চালাচ্ছেন।

অন্যদিকে হেলমেটসহ ন্যূনতম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই যেসব পর্যটক এসব বাইক ভাড়া নিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশেরই নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স বা বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা। দুজনের একেকটি টিম চার ঘণ্টা, ছয় ঘণ্টা, আট ঘণ্টা কিংবা সারা দিনের জন্য মোটরসাইকেলগুলো ভাড়া নিচ্ছেন। তাদের কেউই ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারেননি। অনেকের আবার হেলমেটও নেই। তবুও তাদের মোটরসাইকেলগুলো ভাড়া দেয়া হচ্ছে।

স্কুলশিক্ষক শাহ আলম বলেন, কয়েক বছর আগেও বিচসহ আশপাশের এলাকায় মাত্র দুই একটি বাইক ভাড়া দেয়া হতো। অল্প পুঁজিতে মাত্রাতিরিক্ত লাভ হতে থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এই অবৈধ ও জবাবদিহিতাবিহীন ব্যবসা। এদের খপ্পরে পড়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কে কয়েকমাস আগেও এক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক মারা গেছেন। তিনিও রেন্ট-এ-বাইক ভাড়া নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। এভাবেই শিক্ষার্থীসহ পর্যটকদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলেছে।

তার অভিযোগ, মাঝে মধ্যে প্রশাসনের নামকাওয়াস্তে অভিযান দেখা যায়। দুয়েকদিন পর আবারো বড় পরিসরে মরণফাঁদের এই রমরমা ব্যবসায় নেমে পড়েন ব্যবসায়ীরা।পর্যটন ব্যবসায়ী সৈয়দ নূর বলেন, ‘রেন্ট-এ-বাইকের অনেক ব্যবসায়ী পর্যটক বা যাকে ভাড়া দিচ্ছেন, তিনি মোটরসাইকেল চালাতে পারেন কি-না, তা যাচাই না করে টাকার জন্য ভাড়া দিয়ে দেন। পরে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে ভাড়া দেয়ার আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না জিজ্ঞেস করেন। না থাকলে আতঙ্কে ফেলে বেশি টাকা হাতিয়ে নেন।’

বেলি হ্যাচারি এলাকার রেন্ট বাইক ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিনের দাবি, ‘পর্যটকদের চাহিদা থাকায় এ ব্যবসায় নেমেছি। পুলিশ না জানলে তো ব্যবসা বন্ধ থাকত।’ তিনি জানান, সর্বনিম্ন চার ঘণ্টা ভাড়া নিতে হবে। ঘণ্টায় ২৫০ টাকা করে দিতে হবে। তবে সকালে চলাচল কম বলে সর্বনিম্ন দুই ঘণ্টার জন্যও ভাড়া দেয়া হয়। আর সারা দিন অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা ভাড়া নিলে এক হাজার ৮০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।’ মোটরসাইকেলগুলোর লাইসেন্সের বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের চুক্তি আছে বলেও দাবি নাসির উদ্দিনের।

ঢাকার রামপুরা থেকে আসা সুজয় বিশ্বাস বলেন, ‘স্ত্রী মোটরসাইকেল নিয়ে মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণ করতে চেয়েছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও মোটরসাইকেল ভালো চালাতে পারি। তাই সাহস করে চার ঘণ্টার জন্য ১ হাজার টাকায় ভাড়া নিলাম।’ চালক সুজয়ের মাথায় হেলমেট দেখা গেলেও তার স্ত্রীর মাথায় কোনো নিরাপত্তা হেলমেট ছিল না।

সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, কক্সবাজারের এই মনোরম মেরিন ড্রাইভ সড়কে দিনে গড়ে ১২/১৩টি বাইক দুর্ঘটনা ঘটছে। আহত রোগীরা তাদের কাছে আসেন মারাত্মক জখম নিয়ে। জেলা প্রশাসন একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও এই রেন্ট-এ বাইক ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না বলে জানান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান হোসাইন সজীব। তিনি বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভে প্রায় বাইকই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। তাদের বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনো অনুমতিও নেই। এসব অবৈধ বাইক ধরতে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।’ বাইক ভাড়া বন্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসও দেন তিনি।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং জেলা পুলিশের মুখপাত্র জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভে রেন্ট বাইক মৃত্যুর ফাঁদ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। তবে নিয়ম-নীতি না মেনেই এসব বাইক মেরিন ড্রাইভে ব্যবহার করছেন এসব ব্যবসায়ীরা। যদিও এসব ব্যবসায়িক অনুমতি দেয়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখে। অবৈধ এই ব্যবসায়ী এবং বাইক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’ সামনে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া এসব বাইক ভাড়া দেয়া মারাত্মক ঝুঁকির। মেরিন ড্রাইভে অবৈধ রেন্ট-এ বাইক ও পর্যটকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় এ ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি পর্যটকদের সচেতনতা বাড়ানোর আহ্বানও তাদের।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ