‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ শব্দটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে আলোচনায় আসেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ। বর্তমানে ছাত্র, যুব ও প্রবাসী অধিকার পরিষদের সমন্বয়ক ও গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি। সমসাময়িক রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাসনুভা পূর্বা।
ভিউজ বাংলাদেশ: স্বৈরাচার পতন এবং স্বাধীনতা সম্পূর্ণ আলাদা। নব্বইয়ে এরশাদ সরকারের পতনের পর সেটাকে ‘স্বৈরাচার পতন’ বলা হয়েছে। অথচ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেটাকে ‘স্বৈরাচার পতন’ না বলে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এর পেছনে কি শুধুই অপরিণত আবেগ কাজ করছে, নাকি কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বা কারণ আছে? ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ কথাটা আসলে কেন বলা হচ্ছে?
নুরুল হক নুর: এটা আসলে অনেকে কথার গভীরতা চিন্তা করে বলেন না। কারণ, স্বাধীনতা তো প্রতিটি জাতি একবারই অর্জন করে। আমরা অনেকে এটাকে ‘দ্বিতীয় মুক্তির সংগ্রাম’ বলছি। একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র পেয়েছি; কিন্তু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি পাইনি। স্বাধীন দেশ থেকেও এতদিন মানুষ পরাধীনতার মধ্যে ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত ছিল। অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সর্বদা ভারতীয় আগ্রাসন ছিল। এ কারণেই ভারতের মদদপুষ্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এটাকে আমরা ‘মুক্তি’ বলতে পারি। কিন্তু ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ কথাটাকে কোনোভাবেই সমাজবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় সঠিক বলা যাবে না। এটা মানুষের আবেগের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।
ভিউজ বাংলাদেশ: ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বারবার ব্যবহার করছে দলীয় স্বার্থে। এই ব্যবহার কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলে মনে করেন?
নুরুল হক নুর: ধর্মভিত্তিক দলগুলো আসলে কী করবে বা কাদের দ্বারা ব্যবহৃত হবে, কাদের সাঙ্গে জোট করবে- এ ব্যাপারে তাদের স্বাধীনতা আছে। আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে কি-না, এটা আসলে সেনসিটিভ ইস্যু (হেসে)। আমি এটা নিয়ে মন্তব্য করব না।
ভিউজ বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তী সরকার যদি জাতীয় সরকার গঠন করে, সেখানে আপনাদের কি কোনো ভূমিকা থাকবে? থাকলে সেটা কেমন হবে?
নুরুল হক নুর: আমাদের পরিষ্কার কথা। বিএনপি, জামায়াতসহ যারা বিগত দিনে রাজপথের লড়াইয়ে ছিল, তাদের দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকারে রূপ দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে যদি প্রস্তাব দেয়া হয়, প্রতিনিধি চায়, আমরা দেব। এক্ষেত্রে আমাদের দল থেকে যে দিতেই হবে, এমনটিও নয়। প্রত্যেক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং এ মুহূর্তে রাষ্ট্র পরিচালনায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন- এমন ব্যক্তিদের সংযুক্তি দরকার। সরকার কাঠামোতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি থাকলে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়বে না। গত দুই মাসে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যেহেতু, আন্দোলনের ফ্রন্টে ছাত্ররা ছিল এবং তারা রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান। এখন দেখার বিষয়, তারা কিংস পার্টি হতে চান কি-না, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল গঠন করতে চান কি-না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যত বোঝাপড়া থাকবে, আলোচনা তত পরিষ্কার হবে। সরকারের শক্তির জায়গা তার বিরোধী দলগুলো। আগের যারা পতিত স্বৈরাচার, তারা তো কার্যত হাওয়া। এখন অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যদি সরকারকে সমর্থন না করে, তাহলে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কঠিন হবে। সুতরাং, আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাঠামোকে ‘জাতীয় সরকার’ করা হোক।
ভিউজ বাংলাদেশ: একটা সময় আপনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজনের সমন্বয়কের রাজনৈতিক মেন্টর ছিলেন। বর্তমানে কিছু সমন্বয়কের কর্মকাণ্ডে তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরক্তি বা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ক্ষোভের কারণ আপনার কী মনে হয়?
নুরুল হক নুর: আসলে মানুষ সবসময় তার সক্ষমতা থেকে বেশি কিছু করতে চায়। একটি গন্তব্যে যাওয়ার পর আবার নতুন গন্তব্যে যেতে চায়। এটা স্বাভাবিক প্রবণতা। আমার সঙ্গে শুরু থেকে এই আন্দোলনের অনেকে ছিলেন। আমরা দলের পক্ষ থেকেও তাদের ব্যক্তিগতভাবে অনেক সহায়তা করেছি। এখনো একটি বোঝাপড়া আছে। তবে এটা ঠিক, এই আন্দোলন ঘিরে ছাত্রদের ওপর সাধারণ মানুষের অগাধ আস্থা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ছিল, যেটা গত দুই মাসে অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে কিছু সমন্বয়কের কর্মকাণ্ড, টিএসসিতে ত্রাণ বিতরণের ঘটনা নিয়ে তাদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ছাত্র হয়ে তারা ডিসি-এসপি নিয়োগে সচিবালয়ে সিন্ডিকেটে ইনভলব্ড। এটা কেউ ভালোভাবে নেয়নি। একটা আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছেলে কীভাবে ডিসি-এসপি নিয়োগ দেন। তিনি কি সচিব, যুগ্মসচিব পর্যায়ের কেউ? আমি নিজেও এমনটি শুনেছি। তাবে তারা ঠিক কারা, নামগুলো আমি অত ভালোভাবে জানিও না। এরপর সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা শিক্ষকদের শপথ পাঠ করিয়েছেন, কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গার্ড অব অনার নিচ্ছেন, এ ঘটনাগুলো মানুষকে বিরক্ত করেছে। কথায় বলে, লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: এই আন্দোলনের সুফল সাধারণ মানুষ কতটা ভোগ করবে? দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে, গত এক মাসে গ্যাসের দাম দুই দফা বেড়েছে। দেশ আসলে কোনদিকে হাঁটছে? আসলেই কী বাজারব্যবস্থা সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজির আওতামুক্ত হতে পেরেছে? সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে দখলদারিত্বে পরিবর্তন এলেও দখলদারিত্বের সংস্কৃতির আসলেই কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
নুরুল হক নুর: এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে বেশি দিন হয়নি। সুতরাং, তাদের কিছুদিন সময় আমাদের দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সাময়িক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা গ্যাসের দাম বৃদ্ধিকে আমি খুব ক্ষতিকর হিসেবে দেখি না। কারণ, গত দেড় মাসের আন্দোলনকালে দেশের অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়েছিল, সেটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। গত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে দশ-বারোটা কোম্পানি পুরো সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং প্রচুর টাকা পাচার করেছে। আওয়ামী লীগ যেভাবে লুটপাট করেছে, দখল করেছে, আমরা দেখছি কারা কারা সেটা করছে। এখন যারা করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জনগণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকার- সবাই মিলে নতুন দখলদার, চাঁদাবাজ, লুটেরাদের হটাতে হবে, আওয়ামী লীগকে যেভাবে হটিয়েছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি ডাকসুর সাবেক ভিপি। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামত আসছে। আপনি কী মনে করেন? রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার বাইরে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের অধিকার নিশ্চিতে অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন করা যেতে পারে?
নুরুল হক নুর: ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজ তো হওয়া উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য, আগামীর নেতৃত্ব তৈরির জন্য। কারণ, নেতৃত্ব শুধু রাজনৈতিক নয়; অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব- এসবই মেধাবী তরুণদের তৈরি করা দরকার। শিক্ষার যে মূল লক্ষ্য মানুষের মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো, সে লক্ষ্যে অবশ্যই ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা থাকতে হবে। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি, ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদই ছাত্ররাজনীতিতে প্রথম পরিবর্তন এনেছিল, একটি ঝাঁকুনি দিয়েছিল। আমি মনে করি, দেশের সব উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে অপরাজনীতি বন্ধ হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: গণঅধিকার পরিষদ আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
নুরুল হক নুর: এখন বিশেষ করে আমরা আমাদের দলকে সুসংগঠিত করা, নেতাকর্মীদের মাঝে রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরি এবং বর্তমানে মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে বোঝার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি যেহেতু আমাদের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অনেক ধাপ আছে, এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রয়োজন। সেজন্য আমরা উপযুক্ত নেতৃত্ব গঠন এবং আগামী নির্বাচনে বিশেষ প্রেক্ষাপটে কোনো দলের সঙ্গে যদি আমাদের বোঝাপড়া হয়, সেক্ষেত্রে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে হয়তো জোট হতে পারে। না হলে আমরা বিকল্পভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ, দেশের সাধারণ মানুষ গণঅধিকার পরিষদকে বিকল্প শক্তি হিসেবে দেখতে চায়। সেখানে শুরুতেই কোনো জোটের সঙ্গে মিশে গেলে উদীয়মান দলের বিকাশ থেমে যায়। সে কারণে আমাদের নেতাকর্মীরা চান, গণঅধিকার পরিষদ এককভাবে নির্বাচন করুক। সেটা ছয় মাস হোক বা ছয় বছর পর, যখনই নির্বাচন হোক।
ভিউজ বাংলাদেশ: যদি স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন হয়, সেক্ষেত্রে গণঅধিকার পরিষদের ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার মতো সক্ষমতা আছে বলে মনে করেন কি?
নুরুল হক নুর: রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আগেই বলেছিলাম, গণঅধিকার পরিষদ যদি দল গঠন করে, তাহলে বিকল্প শক্তি হিসেবে এগিয়ে যাবে এবং ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। এ মুহূর্তে ৯০ শতাংশ আসনে প্রার্থী দেয়ার মতো পরিচিতি এবং সক্ষমতা আমাদের আছে। দেশের মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আমরা বিগত দিনগুলোতে দেখেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সংবিধান পুনঃলিখন ও সংস্কার নিয়ে জনগণ পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
নুরুল হক নুর: আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না ঘটানো যায়, সমাজে মানুষের মধ্যে যদি জাগরণ সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে সংবিধান পুনঃলিখন করে, সংস্কার করে বা নতুন আইন তৈরি করে কিছু করা যাবে না। আমরা তো নাগরিকই হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা যাচাই-বাছাই না করে শুধু প্রতীক দেখে ভোট দেই বা ভোটের আগে কেউ ৫০০-১০০০ টাকা দিলে ভোট বিক্রি করে দেই। এই প্রতীক দেখে ভোট দেয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে বা মানসিকতার পরিবর্তন না হলে সংবিধান সংশোধন করেও নতুন কিছু করা যাবে না। তবে এই আন্দোলনের আলোকে কিছু মানুষ মনে করছেন, আমাদের একটা নতুন সংবিধান দরকার, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার থাকবে। ক্ষমতা দখল করে বা ক্ষমতায় গিয়ে কেউ স্বৈরাচার হবে না, এটাও নিশ্চিত করা দরকার। সেক্ষেত্রে নতুন সংবিধান রচনা সময়ের দাবি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে