সরেজমিন বন্যাপরিস্থিতি
শিশুখাদ্যের তীব্র সংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে স্থানীয়রা
ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যাতে নোয়াখালী ও ফেনী জেলাতে এখন পানিবন্দি অবস্থায় আছেন প্রায় ২১ লাখ মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যসংকট। একদিকে খাদ্যসংকট, অন্যদিকে সাপের উপদ্রব; দুইয়ে মিলে নাকাল বন্যাদুর্গতরা। নির্ঘুম রাত কাটছে অনেকের। এদিকে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা বন্যায় গৃহহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। সবচেয়ে বেশি কষ্টে গর্ভবতী নারী ও শিশুরা। পর্যাপ্ত শিশুখাদ্যের অভাব, গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকা এবং নারীদের সুরক্ষাসামগ্রীর অভাবে এই কষ্ট তীব্র হচ্ছে। এ ছাড়াও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সুষম খাদ্যের অভাবও রয়েছে। নোয়াখালী ও ফেনীর বিভিন্ন এলাকার বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখে জানাচ্ছেন ভিউজ বাংলাদেশের প্রতিবেদকরা।
সরেজমিন যা দেখা গেল
বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর, কৃষ্ণরামপুর, দত্তেরহাট ও সোনাপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে আছে। সড়কগুলো তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং জজ আদালত ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণেও হাঁটুপানি। গোটা শহরের বাসিন্দারাই পানিবন্দি অবস্থায় নিদারুণ কষ্টে দিন যাপন করছেন। শহরের প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্ত মানুষের ভিড়।
বন্যার্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলার যেসব সড়কে তুলনামূলক বন্যার পানি কম ওই সব এলাকার নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে এবং বাসাবাড়িতে আটকে পড়া লোকজন কমবেশি সরকারি–বেসরকারি ত্রাণ পাচ্ছেন; কিন্তু জেলা ও উপজেলা এবং ইউনিয়ন সড়ক থেকে দূরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দা সহায়তা পাননি। বন্যার পানি বেশি হওয়া তাদের কাছে কেউই ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন না।
শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ভিউজ বাংলাদেশ প্রতিবেদকরা ওদারহাট নামক স্থানের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সহায়তায় হাঁটুপানির মধ্যেই প্রায় ৪ কিলোমিটার মূল সড়ক পাড়ি দিয়ে রাজগঞ্জ নামক একটি বাজারে পৌঁছান। সেখানে রাস্তার ওপর পানি না থাকলেও তার চার পাশের গ্রামগুলো কার্যত পানির নিচে অবস্থান করছে। স্থানীয় স্কুল ভবনের এবং গ্রামের উঁচু ভবনে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। সেখানে সরকারি ও সেবসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়।
বিকেল ৩টার পর শুরু হয় ভারি বর্ষণ। তার মধ্য দিয়েই স্থানীয় বাজার থেকে আরও ৬ কিলোমিটার দূরের দামদপুর বাজার এবং রামবল্লভপুর স্কুল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা থেকে আসা একটি সামাজিক সংগঠন ত্রাণ বিতরণ করছে। সঙ্গে কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনকেও ত্রাণ দিতে দেখা যায়।
বিকেল ৫টার পরে ওদারহাট নামক স্থানে গিয়ে দেখা যায় স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে ৩৮০ জন। সেখানে ত্রাণের অপেক্ষায় কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় কয়েকশ মানুষকে।
সাদ্দাম হোসেন নামের একজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার বাড়ি মূল সড়ক থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার ভেতরে। বৃদ্ধ মা ও তিন শিশুসহ তার আট সদস্যের পরিবার গত ৬ দিন ধরেই পানিবন্দি। ঘরে যা শুকনো খাবার ছিল, তা দিয়ে গত কয়েকদিন চললেও আজ বাধ্য হয়ে ত্রাণের জন্য এসেছেন।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলে দেখা যায়, বন্যার পানির তীব্র স্রোতে ভেঙে পড়েছে রাস্তা।
গলা পরিমাণ পানি সাঁতরে ঠেকারহাট নামক স্থানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে চারশ মানুষ সেখানের স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া আরও কয়েকশ বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেন। স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠন ‘শান্তিসংঘ ফাউন্ডেশন’ তাদের স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে নৌকায় করে কিছু ত্রাণ নিয়ে এসে সবাইকে সহায়তা করছে।
শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের ওদারহাটে যেতে রাস্তার দু’পাশে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি মৎস্যখামার, পোলট্রি ফার্ম, গবাদি পশুর খামার এবং কয়েক হাজার হেক্টর ফসলের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে সাগরে অতিরিক্ত জোয়ার থাকায় হাতিয়ার মেঘনা নদীর বুকে জেগে থাকা ঘাসিয়ার চর, ঢাল চর, নিঝুম দ্বীপসহ প্রায় সব চর হাঁটু বা কোমরসমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
বানভাসিরাই সাহায্য করছেন বানভাসিদের
নোয়াখালী মূল শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় শহর থেকে ২২-২৫ কিলোমিটার দূরের গ্রামের পানিবন্দি মানুষ ত্রাণ পাননি। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বাড়ি থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী এনে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা প্রতিবেশীদের সাহায্য করছেন।
স্থানীয়রা জানান, এখানে বন্যা শুরুর ৫ দিনে পর সরকারিভাবে কিছু সহায়তা এসেছে, তবে তা প্রয়োজানের তুলনায় অনেক কম।
শিশুখাদ্যের তীব্র সংকট
নোয়াখালীর মাইজদী থেকে পশ্চিমের ওয়াদারহাট পর্যন্ত ঘুরে গত চব্বিশ ঘণ্টায় দেখা যায়, শিশুখাদ্যের তীব্র সংকটে বিপর্যস্ত এসব এলাকা। বিভিন্ন স্থানে পরিবারের বড়দের সঙ্গে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের খাবার দিতে পারছেন মা-বাবারা। অনেক শিশু খাবার না পেয়ে কান্নাকাটি করছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিশুদের জন্য আলাদা কোনো খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় এসব শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
নোয়াখালীর নেয়াজেরডগি নামক স্থানে গিয়ে দেখা যায়, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এই পরিবারগুলোতে রয়েছে ২০ জন শিশু। এর মধ্য ৪ মাসের এক শিশুর মা রহিমা বেগম। গত চার দিন থেকে তিনি শুকনা খাবার খাচ্ছেন। ফলে শুকিয়ে গেছে বুকের দুধ। খাবারের অভাবে কান্না করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে শিশুটি।
শুধু রহিমা বেগমই নন, বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা শিশু ও তাদের মায়েরা প্রবল খাদ্য সংকটে রয়েছেন। শুকনো চিড়ামুড়ি আর কলা খেয়ে কাটছে তাদের দিন। এতে মা ও শিশু উভয়েই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।
শাকিল নামের এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, আমরা বাচ্চাদের মায়েদের জন্য একটু বেশি খাবার দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
ঠেকারহাটের এক আশ্রয়কেন্দ্রে গর্ভবতী নারী রয়েছেন ৫ জন। রশিদ রহমান নামের এক স্বেচ্ছাসেবক তাদের মধ্যে তিনজনকে নৌকায় শহরের সেফ হোমে পাঠিয়েছেন। বিশ্রাম ও খাবারের অভাবে অন্য দুইজনের অবস্থাও খুব শোচনীয়।
অপর্যাপ্ত টয়লেট
ফেনীর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে চারশ মানুষ রয়েছেন। কিন্তু তাদের জন্য টয়লেট আছে মাত্র দুইটি। এত মানুষের চাপে সেগুলোর অবস্থা বেহাল। দুটিই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এ এলাকার মানুষ।
শিশুদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই ফলে এসব শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকিতে আছে। ভিউজ বাংলাদেশ ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাপ্ত অর্থ থেকে কিছু কেন্দ্রে শিশুদের জন্য ডায়াপারের ব্যবস্থা করেছে।
নাই কোনো রাজনৈতিক ভেদাভেদ
দেশ এখন রাজনৈতিকভাবে চরম সংকটময় সময়ের মধ্যে দিয়ে গেলেও বন্যাকবলিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, ধর্ম-বর্ণ এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে কাজ করছেন। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাইরে থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন। আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও এ ধরনের কাজে পূর্বের অভিজ্ঞতা না থাকায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সমন্বয়হীনতা।
সর্বশেষ তথ্য
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জেলার আটটি উপজেলা ও সাতটি পৌরসভা বন্যাকবলিত। এসব এলাকার ১ হাজার ৯৮টি স্থায়ী ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে এরই মধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার ৩০৯ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় পানিবন্দি হয়ে আছেন জেলার ১৯ লাখ ৮১ হাজার ৭০০ জন। বন্যার্ত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ৮৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে