Views Bangladesh Logo

যৌন হয়রানি: ১৬ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি হাইকোর্টের নির্দেশনা

ম্প্রতি সারা দেশে অনেকগুলো যৌন অত্যাচারের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। তবে আইনজ্ঞদের অভিমত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ১৬ বছর আগে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে এমন নিকৃষ্ট ঘটনা অনেকটাই কমে আসতো। তাদের মতে, যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার চর্চা না থাকায় এমন অপরাধ আারও বেড়েছে। সেইসঙ্গে ভুক্তভোগীদের চুপ থাকতে বাধ্য হওয়ার হারও বেড়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক পুরুষ কর্মচারী দ্বারা যৌন হেনস্তার শিকার হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফ অর্ণব ওই নারী শিক্ষার্থীর পোশাক নিয়ে ‘অশ্লীল’ মন্তব্য করেন, ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন করেন। অভিযুক্ত অর্ণব গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে কারামুক্ত হন। মুক্তির পর একদল লোক তাকে ‘সংবর্ধনা’ দেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর তা গোপন রাখে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর কার্যালয়। এরপর ‘হয়রানি ও হুমকি’র মুখে গত বছরের ১৫ মার্চ আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা। এছাড়াও সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রীকে (২৩) যৌন হয়রানি করা হয়। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে শিক্ষা সফরের চারটি স্কুলবাসে ডাকাতির পাশাপাশি তিনজন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ইউনিক রোড রয়েলস নামে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই উত্ত্যক্তকারীদের মাধ্যমে ১১ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। একই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৬৫টি, ২০২৩ সালে ১৪২টি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা জরিপ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে ৫৮% নারী কর্মী শারীরিক বা মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়া প্রায় ৪৩% নারীর কর্মস্থলে যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, কর্মস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির মামলার মাত্র ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে বিচার হয়।

যৌন হয়রানিমূলক সব প্রকার নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলীর করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট দিকনির্দেশনামূলক নীতিমালা ঘোষণা করেন। যাতে বলা হয় এ নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো: ক. যৌন হয়রানি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা, খ. যৌন হয়রানির কুফল সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং গ. যৌন হয়রানি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়- এই নীতিমালা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কার্যকর হবে। এছাড়া যতদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন না হবে ততদিন পর্যন্ত সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুসরণ এবং পালন করা হবে।

এ নীতিমালায় বলা হয়- ১. যৌন হয়রানিমূলক সকল প্রকার ঘটনাকে প্রতিরোধ করতে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ২. প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ প্রয়োজনে তার প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করার জন্য যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ৩. সচেতনতা এবং জনমত সৃষ্টি, সকল নিয়োগকর্তা এবং কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ যৌন হয়রানি প্রতিরোধের লক্ষ্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, ৪. যৌন হয়রানি এবং যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে যথাযথ শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়ন এবং কার্যকর করতে হবে, ৫. যে সকল আচরণ এই গাইড লাইনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন অশোভন আচরণসমূহ সম্পর্কে যদি অপরাধের শিকার নারী অভিযোগ করতে চায় তা গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে ও তা প্রতিকারের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে, ৬. অভিযোগ গ্রহণের জন্য, তদন্ত পরিচালনার জন্য এবং সুপারিশ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সকল কর্মক্ষেত্রে এবং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গ্রহণের জন্য কমিটি গঠন করবে, কমপক্ষে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হবে যার বেশিরভাগ সদস্য হবেন নারী। সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন নারী, ৭. সাধারণভাবে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ কমিটির কাছে অভিযোগ পেশ করতে হবে।

এছাড়া হাইকোর্ট ২০০৯ সালে নীতিমালা দিয়ে সরকারকে দ্রুত তা আইনে পরিণত করতে নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আদালতের নীতিমালাকে ভিত্তি ধরে সম্প্রতি একটি আইনের খসড়া করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যাতে, যৌন হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত ও সুপারিশের জন্য প্রতিটি কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া অভিযোগ তদন্ত প্রক্রিয়া, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, কোন কোন কাজ যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য হবে এবং মিথ্যা অভিযোগ ও সাক্ষ্য দেয়ার শাস্তিসহ বিভিন্ন বিষয় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য হবে যেসব কাজ সেগুলো হলো- যৌনতা বিষয়ক মন্তব্য, বক্তব্য, তামাশা বা অন্যান্য মৌখিক ক্রিয়াকলাপ, যাতে যৌনতার প্রভাব বিদ্যমান; পর্নোগ্রাফি দেখানো বা যৌনতাপূর্ণ বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো বস্তু প্রদর্শন; কোনো কামুক দৃষ্টি, শিস দেয়া বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো অঙ্গভঙ্গি; ব্ল্যাকমেইলিং বা মর্যাদাহানির উদ্দেশ্যে কারো স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ ও সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিতরণ, বিপণন ও প্রচার বা প্রকাশ করা; যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো বস্তু, ছবি, শব্দ, ইমেইল, টেক্সট বার্তা/খুদে বার্তা বা লিখিত নোট ব্যবহার;শারীরিক সংস্পর্শ ও যৌনতার জন্য অগ্রসর হওয়া বা এ ধরনের প্রচেষ্টা; যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রশাসনিক, কর্তৃত্বমূলক বা পেশাদারি ক্ষমতার অপব্যবহার; যৌন অনুগ্রহের দাবি, কিংবা অনুরোধ জানানো; ভয়, প্রতারণা বা মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার প্রচেষ্টা; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে যৌন সম্পর্কযুক্ত আপত্তিকর কোনো তথ্য বা বিষয় প্রকাশ করা বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ আপত্তিকর বার্তা প্রেরণ করা বা কোনো অশালীন মন্তব্য করা; কারো জেন্ডার পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে কটূক্তি করা বা অপমানজনক মন্তব্য করা।’

খসরায় যৌন হয়রানির শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে (ছাত্র ব্যতিরেকে) সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারেন এবং ছাত্রদের ক্ষেত্রে অভিযোগ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে আসা থেকে বিরত রাখতে পারেন। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে এবং সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রের শৃঙ্খলা বিধি অনুসারে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং যদি উক্ত অভিযোগ দণ্ডবিধির যে কোনো ধারা অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে পণ্য হয় তাহলে প্রয়োজনীয় ফৌজদারি আইনের আশ্রয় নিতে হবে যা পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচার হবে।’

হাইকোর্টের নির্দেশনা ও আইনের খসড়া হওয়ার পরও তা বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। যে কারণে যৌন হয়রানির ঘটনা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বেশিরভাগ যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী অভিযোগই দায়ের করেন না। কারণ, ভুক্তভোগীরা ভাবেন অভিযোগ দিলে বিচার না-ও হতে পারে এবং হলেও পরে এ নিয়ে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এমনটা হচ্ছে মূলতো হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাইকোর্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধে যেসব নির্দেশনা ও নীতিমালা ঘোষণা করেছেন তা বাস্তবায়ন হলে বর্তমানে দেশে যৌন হয়রানির এমন বিস্তৃতি ঘটতো না। এর জন্য প্রশাসন হতে শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দায়ী।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০০৯ সালে হাইকোর্ট যৌন হয়রানির বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক নীতিমালা ঘোষণা করেন। যাতে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা, এর শাস্তি, প্রতিরোধ ও সচেতনতার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো গত ১৬ বছরে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা হাইকোর্টের এসব দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগই গ্রহণ করেননি। যাতে করে যৌন হয়রানির ঘটনা কোনোভাবেই কমছে না। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিষয়ে পরিপূর্ণ আইন করতে যাচ্ছে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ