হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নে ধীরগতি
থামেনি নারীর প্রতি যৌন হয়রানি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমানে ৭১ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ৩৯ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি থাকলেও কার্যকর মাত্র ৪৪ শতাংশ। তাই নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধ-সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
বিএনডব্লিউএলএর জরিপে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গত ১২ মাসে দেশে ৪ হাজার ১০৭ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটেছে ১০২টি। এর মধ্যে ৩২ জন কন্যাশিশু। অথচ ২০০৯ সালের ১৪ মে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দীকীর হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি দিক নির্দেশনামূলক নীতিমালা ঘোষণা করে রায় দেন; কিন্তু ওই রায়ের পর ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনার আশানুরূপ বাস্তবায়ন হয়নি। এই সময়ের মধ্যে আইন কমিশনও বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারার কিছু অংশ সংশোধন করেছে; কিন্তু তারা এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
হাইকোর্ট তার রায়ের দিক-নির্দেশনামূলক নীতিমালায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। ২০২২ সালের বিএনডব্লিউএলএর এক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোনো কমিটি হয়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৮৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রীরা কমিটি সম্পর্কে জানে না। নারীদের প্রতি সহিংসতার ৬৬ শতাংশ ঘটনা পারিবারিক; কিন্তু এর মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ আইনি সহায়তার জন্য আসে। এর মধ্যে নারীর পক্ষে রায়ের হার মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ। আবার ২০২৩ সালের জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ অভিভাবক জানেন বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। আবার বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৮৬ শতাংশ জানে যে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। এরপরও প্রায় প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এর মূল কারণ মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা ও দারিদ্র্য। বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এটা তাদের সন্তানের স্বাস্থ্যকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে। অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি নতুন সংযোজন। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
এদিকে, হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে এবং সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। নীতিমালায় যৌন হয়রানি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যৌন হয়রানি বলতে বুঝায়- ১. অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ। যেমন-শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা, ২. প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা, ৩. যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি, ৪. যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন, ৪. পর্নোগ্রাফি দেখানো, ৫. যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, ৬. চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ,কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ, বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা, ৭. প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেয়া বা চাপ প্রয়োগ করা, ও ৮. ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক বা স্থাপনের চেষ্টা করা ইত্যাদি। রায়ে বলা হয়, এ নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- যৌন নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা, যৌন নির্যাতনের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা ও যৌন নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা।
মানবাধিকার নেত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা হলেও কার্যকারিতা খুবই কম। এমনকি শতকরা ১৯ ভাগ প্রতিষ্ঠান এই কমিটি গঠনের বিষয়ে কোনো তথ্যই দিতে পারেনি। ৫৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো অভিযোগ বাক্স।’
মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় সারা দেশে এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এই কারণে এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বেশ কিছু সুপারিশ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশিকা অনুসারে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও কার্যকর করতে হবে; কমিটিগুলোর উদ্যোগ, সুযোগ এবং ক্ষেত্র সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে যাতে ভুক্তভোগীরা ভয় ছাড়াই তাদের ঘটনাগুলো বলতে পারে; নারীদের প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য একটি ছোট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে এবং একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সাংগঠনিক স্তর থেকে প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘আদালতের রায়ে বলা হয়েছে- ইভ টিজিং শব্দটি অপরাধের মাত্রা হালকা করে দেয়, এর পরিবর্তে সর্বস্তরে ‘যৌন হয়রানি’ শব্দদ্বৈতটি ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি থানায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য একটি করে সেল গঠনের আদালতের নির্দেশ ছিল। এ সেল প্রতি মাসে পুলিশ সুপারের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবে; কিন্তু এ সেলের অস্তিত্ব আছে বলে লক্ষ্য করা যায় না।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, হাইকোর্টের নির্দেশনার ১৫ বছর পরেও অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া আউটলেটগুলোতে যৌন নিপীড়ন অভিযোগ কমিটি তৈরি করা হয়নি। দেশের অধিকাংশ কল-কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অভিযোগ কমিটিই নেই। আবার যে সব প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে সেগুলোকে অকার্যকর হয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি থানায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য একটি করে সেল গঠনের আদালতের নির্দেশ ছিল। এ সেল প্রতি মাসে পুলিশ সুপারের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবে; কিন্তু এ সেলের অস্তিত্ব আছে বলে লক্ষ করা যায় না। হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তা মানছে না এবং এই নির্দেশ মানা ও না মানার বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে নেই কোনো নজরদারি।’
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘যৌন হয়রানি সম্পর্কে সর্বস্তরে বিশেষত, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সরকার। যারা হাইকোর্টের নির্দেশনা মানেন না, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। প্রয়োজনে গণপরিসরে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার চিন্তা করা হচ্ছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে