Views Bangladesh Logo

ট্রাম্পের যুগে আমেরিকার গণতন্ত্রের আড়ালে অমাবস্যার হাতছানি

০১৬ সালে মূলত আমেরিকার তথ্যজগৎকে কবজা করার মাধ্যমে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন। রাজনীতির ময়দানে বিতর্ক আর ট্রাম্পকে যেন সমান্তরাল রেখায় এগিয়েছে। ঘৃণাভাষণ থেকে শুরু করে বিপক্ষের রাজনীতিকদের কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে অবস্থিত আমেরিকার আইনসভায় হামলা চালান হাজার হাজার উগ্র ট্রাম্প সমর্থক। তার জন্য কোনো অনুশোচনা নয়, উল্টো ভোট প্রচারে বলেছেন, ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলেও তার সেদিন হাউস ছাড়া উচিত হয়নি! এহেন ট্রাম্পই ফের মার্কিন মসনদে। এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো দেশের নাগরিকরাই তাকে ফিরিয়ে এনেছেন রাজার বেশে। আমেরিকার গণতন্ত্র বা রাজনৈতিক বিশ্বাস সব সময় সবার জন্য সমান ছিল না। ১৯৬০-এর দশকের আগে কৃষ্ণাঙ্গরা পুরোপুরি এর অংশ হতে পারেনি। এখনো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব আমেরিকার রাজনীতিতে শক্তিশালী। গৃহযুদ্ধে দক্ষিণের পরাজয় হলেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি। ধর্মীয় কট্টরপন্থিরা কখনোই বিশ্বাস করেনি, ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা থাকা উচিত।

আর দরিদ্র মানুষের জন্য আইনের শাসন কেবল কাগজে-কলমেই আছে; কারণ তারা পর্যাপ্ত পয়সা খরচ করে ভালো আইনজীবী নিতে পারে না। তবুও আমেরিকার গণতন্ত্র অনেক দিন ধরে এমনভাবে টিকে আছে যেন এটি এক ধরনের বিশ্বাসের অংশ। খ্রিষ্টধর্মের অনেক ধারণা আমেরিকার রাজনীতিতে ঢুকে গেছে। যেমন, আমেরিকা মনে করে তাদের মূল্যবোধ সব মানুষের জন্য এবং তারা সেসব মূল্যবোধ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সও একই কাজ করেছে, কারণ ফ্রান্স ও আমেরিকার গণতন্ত্র দুই বিপ্লব থেকে এসেছে। আর এই বিপ্লব আলোকিত যুগের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়াটা আমেরিকার গণতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থাকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলবে। এটি হয়তো মার্কিন গণতন্ত্রকে ধ্বংসও করতে পারে। আমেরিকার সংবিধানকেও অনেকটা পবিত্র গ্রন্থের মতো মর্যাদা দেওয়া হয়। এমনকি যারা ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থি, তারাও সংবিধানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে। ১৮৩০-এর দশকের শুরুর দিকে ফরাসি চিন্তাবিদ আলেক্সিস দ্য তোকভিল যুক্তরাষ্ট্র সফর করে দেখেছিলেন, খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ দেশটির গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি মনে করেছিলেন, এই নাগরিক ধর্ম আমেরিকার অতিরিক্ত ভোগবাদী জীবন যাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করে। আইন ও স্বাধীনতাকে ভিত্তি ধরে তৈরি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এই আস্থাই বিভিন্ন জাতির অভিবাসীদের একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছিল। অন্যান্য পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এখনো গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ। প্রায় ২৪ শতাংশ আমেরিকান নিজেদের ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান হিসেবে চিহ্নিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বিচারপতিই এখন রক্ষণশীল ক্যাথলিক।

আরেকটি ব্যাপার হলো, ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের দিক থেকে যা-ই হোন না কেন, জনপরিসরে তারা সব সময়ই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মানুষ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেন। অনেকে ট্রাম্পকে ফ্যাসিবাদী বলে থাকেন। তবে ফ্যাসিবাদ সাধারণত একটি সুস্পষ্ট মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে চলে; যা ট্রাম্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তার আশপাশের লোকজন তারা আদর্শগত দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ নয়। মুসোলিনি বা অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শাসকের মতো তারা শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চান না। বরং তারা অনেক সরকারি কাঠামো ভেঙে ফেলতে চান। ট্রাম্পই প্রথম আমেরিকান রাজনীতিবিদ নন যিনি শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মনের অভিবাসনভীতি ও ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এবং উদারপন্থি নেতাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেছেন।

তবে অন্যদের চেয়ে তার সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দিক হলো-তিনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকাশ্যেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। যেমন, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক গাজা থেকে সরাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেষ্টাকে যুদ্ধাপরাধের সমান বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এর মধ্য দিয়ে আরও একটি নাকবার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে প্রায় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি। গাজার পুনর্গঠনের প্রলোভন দেখিয়ে ফিলিস্তিনিদের উপত্যকাটি থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের আগেই হয়তো এ নিয়ে ছক কষেছেন তিনি। তাইতো যুদ্ধবিরতির চুক্তির নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ে এসে পুরো উপত্যকাটি গ্রাস করতে চান ট্রাম্প। গাজা কিনে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। যদিও, অনেকেই বলছেন, গাজা দখলে নতুন নতুন পন্থায় খেলছেন কৌশলী ট্রাম্প।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজাবাসীকে অনৈতিকভাবে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসনের মধ্য দিয়ে উপত্যকাটিতে থেকে ফিলিস্তিন জাতির নাম পুরোপুরি মুছে দিতে চাইছেন ট্রাম্প।১৯৪৮ সালে নাকবার সময় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলিরা যা করেছিলো, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে এবার। গাজায় বিশ লাখ ফিলিস্তিনি আরও একটি নাকবা দেখতে যাচ্ছে। তাদের নিজ ভূমি ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে বলছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে। আসলে ফিলিস্তিনিদের নিয়ে কী করতে চান ট্রাম্প, তা বোঝা মুশকিল। প্রায় প্রতিদিনই উপত্যকাটি নিয়ে নতুন নতুন ঘোষণা দিচ্ছেন তিনি। এমনকি ট্রাম্পের এসব ঘোষণা স্রেফ কোনো কৌশল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে। তাছাড়াও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র বিচার ব্যবস্থা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং আইনের শাসন-এসব গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলেও ট্রাম্প এগুলোকে পাত্তা দেন না।

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে প্রথম সপ্তাহেই তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেছেন। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ফেডারেল বাজেট আটকে দিয়েছেন। জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বাতিলের ঘোষণা দেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধান বিশেষজ্ঞ লরেন্স ট্রাইব একে আইন ও সংবিধানের ওপর সরাসরি আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছেন। ট্রাম্প এমন কাজ করছেন যা আমেরিকার দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করছে। এই শাসনব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হলেও এত দিন তা দেশকে এক সঙ্গে ধরে রেখেছিল; কিন্তু ট্রাম্প সেটি ধ্বংস করে এক নতুন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন যেখানে একজন নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য থাকতে হবে। জার্মানিতে একসময় একে শাসকই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারবে না। ট্রাম্পের কিছু সমর্থক মনে করেন, তিনি ঈশ্বরের মনোনীত একজন নেতা। এই ধরনের অন্ধ ভক্তি সাধারণত কঠোর একনায়কতন্ত্রে দেখা যায়, কিন্তু এর আগে কখনোই এটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়নি।

১৯৩০-এর দশকে ‘নিউ ডিল’ কার্যকর করার সময় ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট পদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন। এটি তার রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষুব্ধ করেছিল। তবুও তার অনেক সমর্থকের মতে এটি দেশের সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ছিল; কিন্তু রুজভেল্ট তখনো আইন অমান্য করেননি। তিনি সংবিধানকে আঘাত করেননি বা বিদ্রোহ উসকে দেননি। তিনি তার দলকে অন্ধ সমর্থনের ভিত্তিতে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো গড়ে তোলেননি; কিন্তু ট্রাম্প এসব করছেন। হুমকি দিয়ে, চাপে রেখে এবং ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তিনি রিপাবলিকান দলটিকে নিজের হাতের মুঠোয় এনেছেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব কী হবে, তা এখনই বলা কঠিন।

যদিও ট্রাম্পবাদ খুব বেশি দিন টিকে নাও থাকতে পারে। এর কারণ হলো, ট্রাম্পের রাগী ও আত্মকেন্দ্রিক আচরণ কোনো শক্তিশালী আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি যা দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক প্রভাব রাখতে পারে। ট্রাম্পের অনেক সমর্থকই হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হতাশ হবে, কারণ তার অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নেয়নি। যদি শেয়ারবাজারে বড় ধস নামে, ডেমোক্রেটিক পার্টি শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে বা আদালত তার স্বেচ্ছাচারিতার ওপর লাগাম দেয়, তাহলে তার প্রভাব অনেকটাই কমে যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার শেষ নির্দেশ বা লাস্ট অর্ডার মার্কিন শীর্ষকর্তাদের দিয়ে রাখলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প; কিন্তু কি নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প? নির্দেশে ট্রাম্প বলেছেন 'ইরান যদি আমাকে খুন করে তবে ওদেরও ধ্বংস করে দিও; কিন্তু কেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন আজব নির্দেশ? নিজেই তার উত্তরও দিয়েছেন ট্রাম্প। স্পষ্ট জানিয়েছেন ইরান যেমন ভাবে পারমানবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় মেতেছে তাতে ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপের নীতিই ফেরানোর কথা ভাবছে আমেরিকা।

ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে নির্দেশ দিয়েছি। ইরানকে আমেরিকার জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে দেব না। এরপরই ট্রাম্পের সংযোজন এর জন্য ইরানের গুপ্তচরেরা যদি আমাকে খুন করে তাহলে ইরানকে ধ্বংস করে দিও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইরান নিয়ে ওবামা এবং বাইডেন জামানার মধ্যপন্থা থেকে চরম পন্থার দিকেই ফের ফিরতে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে অস্থিরতা তৈরি হবে তেলের বাজারেও। যেটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তবে ট্রাম্পের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী না হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে এমনভাবে ধ্বংস করে যেতে পারেন, যা হয়তো আর ঠিক করা যাবে না। যদি তা ঘটে, তাহলে তার শাসনের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক দিন ধরে রয়ে যাবে। ট্রাম্প নিজে হয়তো একসময় রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে যাবেন; কিন্তু তার রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ হয়তো বহু বছর পর্যন্ত দৃশ্যমান থেকে যাবে। তবে এখন শুধু দেখার বিষয় ট্রাম্পের যুগে আমেরিকার গণতন্ত্র কোনদিকে গড়ায়।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ