শহীদ আনোয়ারা পার্ক: দাও ফিরে সে অরণ্য…
কয়েকটি প্ল্যাকার্ড-
১. আনোয়ারা উদ্যান বাঁচাও
২. উদ্যান নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করো
৩. শহীদ আনোয়ারা উদ্যানে শপিংমল চাই না
৪. আনোয়ারা উদ্যান ফেরত চাই
এরকম আরও অনেক স্লোগান ও দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজধানীর ব্যস্ততম ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কিছু মানুষ- যারা পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাপারে সংবেদনশীল। গত শনিবার (১৮ মে) বিকেলের এই আয়োজন থেকে ঘোষণা এসেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কর্তৃপক্ষ ৩০ দিনের মধ্যে এখান থেকে মেট্রোরেলের স্থাপনা সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে যদি আনোয়ারা উদ্যানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ না নেয়, তাহলে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে।
মেট্রো স্টেশনের নিচে যেখানে এই সংহতি সমাবেশ হলো, সেখানে মেট্রোরেলের কাজ শুরুর আগেও প্রচুর গাছপালা ছিল; কিন্তু বড় এই স্টেশনের কংক্রিটের নিচে চাপা পড়েছে পার্ক, গাছপালা এবং এই পার্কের ওপর নির্ভরশীল প্রাণ-প্রকৃতি। অথচ এই শহীদ আনোয়ারা উদ্যান পার্ক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিবিজড়িত স্থান। মেট্রো স্টেশন করতে গিয়ে পার্কটিকে গাছশূন্য করার পরে এখন সেখানে শপিংমল তৈরির পরিকল্পনা চলছে।
এই পার্কটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্বাচনি এলাকা। গত বছরের অক্টোবরে এখানে যখন পার্কটি রক্ষার দাবিতে পরিবেশ সচেতন মানুষ মানববন্ধন করেন, সেখানে এসে সংহতি জানিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, ‘ষাটের দশকের শেষ দিকে ৬ দফার আন্দোলন যখন শুরু হয়, চলমান আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৬৭ সালে সন্তানকে দুগ্ধ পানরত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে আনোয়ারা বেগম নামে এক নারী নিহত হন। পরে তার স্মৃতি রক্ষার্থে এ উদ্যানটির নাম দেয়া হয় ‘শহীদ আনোয়ারা মাঠ’- পরে এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন পার্কও গড়ে তোলা হয়; কিন্তু সেই উদ্যান, মাঠ ও পার্ক এখন কেবলই স্মৃতি। এখন ‘শহীদ আনোয়ারা উদ্যান পার্ক’ লেখা একটি সাইনবোর্ড ছাড়া এখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তেজগাঁও কলেজের উল্টো দিকে, অর্থাৎ মেট্রো স্টেশনের দক্ষিণ প্রান্তের গেট দিয়ে ওপরে উঠে নিচের দিকে তাকালে দেখা যায় পার্কের একটি বড় অংশ এখন মেট্রোরেলের প্রবেশ পথ। বাকি পুরো জায়গাটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা। তার ভেতরে মেট্রোরেলের নানা সরঞ্জাম। এই পার্কের ভেতরে অসংখ্য গাছপালা ছিল। বেশ বড় আকারের অনেকগুলো কামিনী ফুলের গাছ ছিল। বড় গাছের নিচে ছিল কংক্রিটের বেঞ্চ। ছিল পায়ে হাঁটার পথ। ক্লান্ত মানুষেরা ওই বেঞ্চে বসতেন। অবসরে আড্ডা দিতেন।
স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ হাঁটতেন; কিন্তু সেখানে এখন একটি মাঝারি সাইজের অশ্বত্থ ও কদম গাছ ছাড়া আর কোনো গাছ নেই বললেই চলে। অর্থাৎ পুরো পার্কটি ধ্বংস করা হয়েছে। পার্কের জায়গাটি এখন বিরানভূমি এবং সেখানে বেশ কিছু নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা। শোনা যাচ্ছে এখানে শপিংমল হবে। অথচ যখন এখানে মেট্রো স্টেশনের কাজ শুরু হয়, তখন থেকে বলা হচ্ছিল যে, স্টেশনের কাজ শেষ হয়ে গেলে পার্কের জায়গা ছেড়ে দেয়া হবে এবং আগের মতোই এখানে পার্ক গড়ে তোলা হবে।
বাস্তবতা হলো, এই পার্কটিকে আর কোনোভাবেই আগের চেহারায় ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কেননা এখানে যে বড় গাছগুলো ছিল, সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। যদি কর্তৃপক্ষ জায়গাটি পার্কের জন্য ছেড়েও দেয়, তারপরও এখানে নতুন করে গাছ লাগালে সেগুলো ছায়াদানের উপযোগী হতে ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগবে। হয়তো কিছু ফুলের গাছ ও ঘাস লাগিয়ে উদ্যানটিকে সবুজ করা যাবে। চাইলে একটা ছোট লেক তৈরি করে তার চারপাশে হাঁটার রাস্তাও বানানো যাবে। বসার জন্য কিছু বেঞ্চ বানানো যাবে; কিন্তু তারপরও পার্কটির আগের প্রতিবেশ ফিরিয়ে দেয়া যাবে না; কিন্তু এই কাজগুলোও হবে কি না- সেটিই এখন বিরাট প্রশ্ন। কেননা পার্কের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে মেট্রোরেলের মালিকানায় চলে গেছে।
বাকি জায়গাটুকু তারা কবে ছাড়বে বা আদৌ ছাড়বে কি না, সেটিই প্রশ্ন। কেননা শোনা যাচ্ছে, এই শূন্য জায়গায় এখন শপিংমল হবে।
কী অদ্ভুত উন্নয়ন চিন্তা, উন্নয়ন দর্শন! বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একটি স্থান দখল করে, ধ্বংস করে সেখানে শপিংমল বানাতে হবে? একটা শহরে কত শপিংমল প্রয়োজন? মানুষ কি শুধু শপিং করবে আর রেস্টুরেন্টে খাবে? তার অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই? তার গাছের ছায়া লাগবে না? তার হাঁটার জায়গা, বসার মতো বেঞ্চ প্রয়োজন নেই? সব মানুষ শপিংমলের ভেতরে ঢুকে এসির হাওয়া খাবে? আর একটা পার্ক বা উদ্যান কি শুধু মানুষের জন্য? পৃথিবীতে কি শুধু মানুষেরই বাঁচার অধিকার? অন্য কোনো প্রাণী থাকবে না? এই পার্কে যে বড় বড় গাছগুলো ছিল, যে গাছগুলোয় পাখিদের বাসা ছিল, যে ফুলের গাছগুলোয় প্রজাপতিরা উড়তো, সেই পাখি ও প্রজাপতিতের আবাসস্থল ধ্বংস করার অধিকার মানুষকে কে দিয়েছে?
গত বছর যখন এখানে এরকম মানববন্ধন হয়, তখন এখানে এসে সংহতি জানিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামও। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘ফার্মগেটে অনেক শপিংমল, মার্কেট রয়েছে। নতুন করে আর দরকার নেই। এখানে যে উদ্যান ছিল, সেটা পুনরুদ্ধার করে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘যারা মাঠ নষ্ট করে মার্কেট করতে চান, আমি তাদের বলছি, আমি জনগণকে নিয়ে এখানে প্রতিহত করব। এখানে কোনো ধরনের মার্কেট হবে না, হবে না এবং হবে না। এখানে মাঠ হবে ফার্মগেট এলাকাবাসীর জন্য।’
যখন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই পার্কের ইতিহাস বলেন; যখন স্বয়ং সিটি মেয়রও ঘোষণা করেন যে, এখানে কোনো শপিংমল হবে না- তখন আমাদের আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে; কিন্তু মুশকিল হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উন্নয়নের সঙ্গে নদী-খাল-জলাশয়-গাছ ও প্রাণ-প্রকৃতিকে এতটাই মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এখন মনে হয় এগুলো বুঝি এখন উন্নয়নের শত্রু! কোনো একটা প্রকল্প মানেই গাছ কাটো। গত অর্ধ শতাব্দী ধরে আমরা এমন একটি রাষ্ট্র বানালাম, যার কাছে নদীর চেয়ে কারখানার গুরুত্ব বেশি। রাস্তা ও সেতুর গুরুত্ব বেশি। যার কাছে খাল-পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের চেয়ে আবাসন প্রকল্পের গুরুত্ব বেশি। পার্কের চেয়ে শপিংমলের গুরুত্ব বেশি। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চেয়ে রেললাইনের গুরুত্ব বেশি। ম্যানগ্রোভ বনের চেয়ে চিংড়ি ঘেরের গুরুত্ব বেশি। প্রাণ-প্রকৃতি-ইতিহাস-সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি মানুষের জীবনের চেয়েও টাকার গুরুত্ব বেশি।
এরকম একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দাঁড়িয়ে, এরকম একটি অদ্ভুত সময়ে, একটি ছোট্ট পার্ক রক্ষার দাবিতে যে এতগুলো মানুষ রাস্তার পাশে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ালেন, তাতে মনে এ প্রশ্ন জাগাটাও অস্বাভাবিক নয় যে, এই প্রতিবাদী মানুষগুলো বোকা নাকি আমাদের নীতিনির্ধারক, আমাদের জনপ্রতিনিধি, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, আমাদের ব্যবসায়ী তথা পয়সাওয়ালারা অন্ধ? কেননা যে ইঞ্জিনিয়ার এই মেট্রো স্টেশনের ডিজাইন করেছেন, তিনি একজন মেধাবী মানুষ। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন। যে মন্ত্রী ও সচিবরা এই প্রকল্পে স্বাক্ষর করেছেন, তাদের পড়ালেখাও কম নয়। অথচ এই পার্কের পাশে ফুটপাতে যে লোকটি চা বিক্রি করেন, তিনিও জানেন এই পার্কটি তাদের কাছে কত বড় আশীর্বাদ ছিল। তিনিও জানেন একটা জনপদে, একটা কমিউনিটিতে একটা পার্কের কী গুরুত্ব। দশটা বড় গাছ একটি এলাকার জন্য কত বড় আশীর্বাদ। একটা পুকুর কতটা জরুরি।
একজন সাধারণ মানুষও জানেন যে, দশ কোটি টাকা হলেই একটা কারখানা বানানো যায়; কিন্তু একশ কোটি টাকা দিয়েও একটা নদী বানানো যায় না। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা গেছে, আমাদের রাষ্ট্রীয় অনেক উন্নয়ন প্রকল্পই নদীবিরোধী, গাছবিরোধী, জলাশয়বিরোধী। যে উন্নয়ন প্রকল্প একটি জনপদ থেকে একটি নদী খেয়ে ফেলে। খালকে ড্রেনে পরিণত করে। যে উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলতে হয়, পার্ক ধ্বংস করে বিরানভূমি বানাতে হয়, সেই উন্নয়ন প্রকল্প স্পষ্টতই দেশ ও মানুষবিরোধী। অবকাঠামো মানেই উন্নয়ন নয়। বরং পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি ঠিক রেখে অবকাঠামো নির্মাণই যে আধুনিক উন্নয়ন চিন্তা- আমরা সেখান থেকে ঢের দূরে বসবাস করছি।
আমাদের এই আত্মঘাতী উন্নয়নচিন্তাটি রবীন্দ্রনাথ বহু বছর আগেই টের পেয়েছিলেন। লিখেছেন:
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি।’
অতএব, দেশের মানুষ উন্নয়ন চায়। সেও চায় মেট্রোরেলে চড়ে দ্রুত এখান থেকে ওখানে যেতে; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এই মেট্রো স্টেশনের বিনিময়ে তার কাছ থেকে তার পার্কটি কেড়ে নেয়া হবে। তাকে অক্সিজেন ও ছায়া দানকারী বৃক্ষ উজাড় করে সেখানে শপিংমল বানাতে হবে। মানুষ রাস্তা চায়। সেতু চায়; কিন্তু সেই রাস্তা ও সেতু বানাতে গিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে নদীকেই বিপন্ন করা হবে- এমন আত্মঘাতী উন্নয়ন দেশবাসী চায় না। মুশকিল হলো, প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতিকে যেভাবে বিবেচনায় রাখার দরকার ছিল, সেটি রাখা হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই এখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল ক্ষমতায় থাকার পরও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিবিজড়িত একটি ছোট্ট পার্ক রক্ষার দাবিতেও সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়। এটি যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে বেশি লজ্জার।
লেখক: সম্পাদক, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে