Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ভোট দান বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশে কি ‘না ভোট’ আবার চালু করা উচিত?

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ত বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের এক তরুণ বললেন, রংপুর-৩ আসন জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত হলেও ‘না ভোট’ থাকলে দ্বাদশ নির্বাচনে হয়তো সর্বোচ্চ সংখ্যাক ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত।

যদিও জাতীয় পার্টি গঠনের পর থেকে কোনো জাপা প্রার্থী ওখানে কখনো হারেনি; কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। কারণ নির্বাচনের আগে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য জাপার চেয়ারম্যান ওখানে তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন। আবার, এ কথাও সত্য যে, এ জাতির মানসিকতা কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে বলে তুমি মনে কর? ছাত্রটির নাম আদিত্য (ছদ্মনাম), বলেন, স্থানীয়রা আসলে কখনোই একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিত না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র কৌতূহলী হয়ে কাছে গেলে জাকির হোসেইন আর আদিত্য বললেন, যেভাবে জি এম কাদের সংসদে কথা বলেছেন তার কোনো মানে হয় না। বিশেষ করে যখন পার্টির সবার দাবি অগ্রাহ্য করে তিনি সব সম্ভাব্য সুবিধা পেয়ে নির্বাচনে গেছেন।

আড্ডার এক সদস্য, আদিত্যর মিরপুরের এক বন্ধু বললেন, ২০০৯ সালের পর থেকে ‘না ভোট’ থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক ছাত্র বললেন, ভোটারদের যদি প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা থাকত, তাহলে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি হতো। কাউকে আসন দেয়ার আগে দলগুলো আরও বাস্তবসম্মতভাবে ভাবত।

তিনি আরও বলেন, আর্জেটিনা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো, ‘না ভোট’-এর অস্ত্র ব্যবহার করে সরকার ভোটদান বাধ্যতামূলক করতে পারে।

বাংলাদেশের দুটি বড় দলের একটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বিএনপি এবং তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এবারের নির্বাচন বয়কট করেছে। দেশের বেশ কয়েকজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তাই পরামর্শ দিয়েছেন ব্যালট পেপারে ‘না ভোট’ বিধান রাখার জন্য।

সবেক নির্বাচন কমিশনার (২০০৭-১২) মেজর জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গত বছর ডিসেম্বরের শুরুতে এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে, এত কম ভোট পাওয়া নির্বাচনের জন্য ক্ষতিকর। এর চেয়ে বরং ‘না ভোট’ একটা ভালো সমাধান হতে পারে।

তিনি আরও যোগ করেন, এর জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনেক কাজ করতে হবে; কিন্তু ইসির দৃঢ় মানসিকতাই এ ব্যাপারে একমাত্র সহায় হতে পারে।

বাধ্যতামূলক ভোট সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রতি-উত্তরে বলেন, এই পদ্ধতি নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে; কিন্তু চেষ্টা তো করা যেতে পারে।

বর্তমান ইসির প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এই পদ্ধতি আবার চালু করবে কি না, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। যদি তারা চায় নতুন সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে।

সিইসি এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্যের মধ্যে সাখাওয়াত হোসেন একজন, একমাত্র ‘না ভোট’ অপশনের কারণে আজ পর্যন্ত দেশের সবেচেয়ে সাহসী নির্বাচন কমিশন হিসেবে বিবেচিত হন।

সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২, জারি করে কমিশন প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে ‘না ভোট’ চালু করে ২০০৮ সালে। এই বিধানের বলে ভোটাররা শেষ পর্যন্ত একটি বিকল্প পেয়েছিলেন। কোনো প্রার্থী পছন্দ না হলে ‘ওপরের কেউই না’ অপশন ছিল। না ভোটের প্রতীক ছিল ক্রস চিহ্ন।

কমিশনের যুক্তি ছিল যে, না ভোট ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ে চাপ দিবে। ভোটের সময় সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকবেন।

নানা কারণে ইসি ‘না ভোট’ সম্পর্কে বেশি প্রচার চালাতে পারেনি; তবুও তরুণরা এটা খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। ফলে গত নির্বাচনে ‘না ভোট’ রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় সপ্তম সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিল। এমন কি রাজধানীর একটি ভোটকেন্দ্রে ‘না ভোট’ই জয়ী হয়েছিল; কিন্তু, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে এই সংশোধনী বাতিল করে। তারপর প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এতে কোনো রা-শব্দ করেনি।

ভোটদান বাধ্যতামূলকও করা উচিত। বাধ্যতামূলক ভোট সাম্প্রতিক ধারণা না। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ এবং আফ্রিকার মোট ২৫টি দেশে এই আইন বলবৎ আছে। যদিও মাত্র ১০টি দেশই এটি প্রয়োগ করে।

বাধ্যতামূলক ভোট প্রদান ব্যবস্থা হিসেবে বেলজিয়াম সবচেয়ে পুরোনো। ১৮৯৩ সাল থেকে সেখানে পুরুষদের জন্য ভোটদান বাধ্যতামূলক। আর নারীদের জন্য তা বাধ্যতামূলক হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। অন্য দিকে জাতীয় নির্বাচনে বাধ্যতামূলক ভোটদান পদ্ধতি অস্ট্রেলিয়ায় চালু হয় ১৯২৪ সাল থেকে। আর আর্জেটিনায় ১৯১২ সাল থেকে।

legalanswers.sl.nsw.gov.au অনুসারে বাধ্যতামূলক ভোটদান ভোটারদের পছন্দকে বুঝতে সাহায্য করে। এতে তাদের নাগরিক দায়িত্বও বোঝা যায়। প্রার্থী বাছাই এতে সহায়তা করে। নির্বাচনের সময় অপছন্দের প্রার্থীকে এখানে হালকা শাস্তিও দেয়া যায়। নির্বাচনের বাস্তবতা বোঝা যায়। নেতাদের বাগাড়ম্বর থেকে বাঁচায়। আয় বৈষম্য কমায়। ভোটদানের বিধিনিষেধ অপসারণ করে। রাজনৈতিক মঙ্গল ও শিক্ষা-ব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করে।

যাই হোক, এটি কতখানি ভালো বা মন্দ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটি অবৈধ ব্যালটের ঘটনা বা ভোট কেনার ঘটনাও বাড়াতে পারে।

২০০৮ সালে জেমস ব্রুকি একটি থিসিস প্রকাশ করেন, The Effect of Compulsory Voting Laws on Government Spending শিরোনামে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন বাধ্যতামূলক ভোটদান আইন এবং সরকারি ব্যয়ের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক নেই।

আরেকটি গবেষণা করেছেন কারেল কাউবা এবং স্ট্যানি্স্লাভ মাইসিকা। তাদের গবেষণার শিরোনাম ছিল: বাধ্যতামূলক ভোট কি বৈষম্য কমাতে হবে? তারা দেখিয়েছেন যে বাধ্যতামূলক ভোটদান নির্বাচনি অংশগ্রহণ বাড়াতে পারে। এতে আয় ও শিক্ষার ওপর নিশ্চিত প্রভাব পড়বে। একটি ভারসাম্য আনতে সহায়তা করবে।

যাই হোক, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে ২৫টি দেশ বাধ্যতামূলক ভোটদান নিশ্চিত করেছে এবং তাতে তারা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকাও রাখতে পারছে। একেবারে অস্তিত্বহীন থেকে অনেক ভোটারের উপস্থিতি বাড়ছে। আর তাই কিছু দেশে ভোট প্রদান শুধু অধিকার নয়, এটা দেয়া দায়িত্ব।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ