ডেঙ্গু মোকাবেলায় সচেতনতাই একমাত্র প্রতিকার
দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় এ বছর গুরুতর না হলেও চিকিৎসক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদরা সতর্ক করে বলছেন, এটি যে কোনো সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই মুহূর্তে জনসচেতনতা বাড়ানোই ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র কার্যকর উপায় হতে পারে।
চলতি বর্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ডেঙ্গু দমনে পর্যাপ্ত কর্মসূচি হাতে না নেওয়ার কারণে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও জানাচ্ছেন কীটতত্ত্ববিদ ও সংক্রমণ বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাওয়ার সময় ও ধরণ পাল্টানোর কারণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০২ জনে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারিতে ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, মার্চে ৫ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৮ জন, জুলাইয়ে ১২ জন, আগস্টে ২৭ জন এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম ১১ দিনে ১৯ জন মারা গেছেন ডেঙ্গুতে।
মৃত্যুর পাশপাশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে। অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মশাবাহিত রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার। তবে ২০২৩ সালের একই সময়ের মধ্যে প্রায় ৭৪১ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন এবং আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছিল দেড় লাখ।
গত বছর ডেঙ্গুতে মৃতদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ৩৪ জন, জুনে ২০৪ জন, আগস্টে ৩৪২ জন এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম ১১ দিনে ১৪৮ জন মারা গেছেন। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৯৬ জন, অক্টোবরে ৩৫৯ জন, নভেম্বরে ২৭৪ জন এবং ডিসেম্বরে ৮৩ জন।
পরিসংখ্যানে নজর দিলে দেখা যায়, গত বছর ডেঙ্গুতে সর্বাধিক সংক্রমণের সময় ছিল অক্টোবর মাস। সামনেই অক্টোবর, তাই এখন থেকেই আমাদের অতিরিক্ত সচেতন থাকতে হবে। জনসচেতনতাই একমাত্র সমাধান। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম শারোয়ার বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এ বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অভিযানে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি।’
এছাড়া বছরের পর বছর প্রয়োগ করা কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে বেশিরভাগ মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তির জন্য দায়ী সেরোটাইপ-২ ডেঙ্গু। এ ধরণের ডেঙ্গু সংক্রমণে মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা বেশি।
কীটতত্ত্ববিদরা আশঙ্কা করছেন, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে অক্টোবরে ডেঙ্গুতে প্রাণহানি আরও বাড়তে পারে। কর্তৃপক্ষ যথাযথ নজর না দিলে ডেঙ্গুর মৌসুম নভেম্বর পর্যন্তও বিস্তার ঘটতে পারে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নাজির আহমেদ বলেন, ‘আগে ডেঙ্গু সংক্রমণের সর্বোচ্চ ব্যাপ্তি ছিল জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু তা পরিবর্তিত হয়ে এখন জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, এমনকি ডিসেম্বর পর্যন্তও সক্রিয় থাকে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে ডেঙ্গুর এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এ বছর সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকলেও যে কোনো মুহূর্তে তা লাফিয়ে উঠতে পারে। আর এ অবস্থায় জনসাধারণের ব্যক্তি সচেতনতাই একমাত্র সমাধান হতে পারে। মানুষকে প্রতি ঘণ্টায় তাদের বাড়িঘর এবং আশেপাশের জায়গা পরিষ্কার করতে হবে এবং কোনকিছুতে বেশিক্ষণ পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
এদিকে সম্প্রতি দায়িত্ব পাওয়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক দাউদ আদনান জানিয়েছেন, তারা আশা করছেন এ বছর ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হবে না এবং সংক্রমণের হার নিম্নমুখী থাকবে। তবে তারা সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখেছেন। ইতোমধ্যে দেশের সব হাসপাতালকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি সেবা প্রদানে কোনো বাধা সৃষ্টি করছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনিক পর্যায়ে কিছু সমস্যা আছে। তবে যাই হোক না কেন, আমরা হাসপাতালগুলিতে আগের মতো একইভাবে চিকিৎসসেবা নিশ্চিত করেছি।’
দাউদ আদনান বলেন, ‘হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের অনলাইনে পরিচালনা করা হচ্ছে, যাতে কোনো বাধা ছাড়াই জনসাধারণকে সব ধরণের পরিষেবা প্রদান করা যায়। তিনি আরো বলেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতালগুলোকে অতিরিক্ত শয্যা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে