Views Bangladesh Logo

সংস্কারের ‘ষড় ক’ এবং অর্থনৈতিক সংকটের পদধ্বনি

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

সংস্কার বলতে আপনি কী বোঝেন- সেটি নির্ভর করে আপনি কে, আপনার পেশা কী, আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মত কী, কোন দলের সমর্থক এবং সর্বোপরী দেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কী- তার ওপর। একজন রিকশাচালক সংস্কার বলতে যা বোঝেন, একজন রাজনীতির অধ্যাপকের কাছে সংজ্ঞাটি হয়তো সেরকম নয়। আবার জুলাই অভ্যুত্থানে যে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো সক্রিয় ছিল, তাদের সবার কাছেও সংস্কারের সংজ্ঞা এক নয়। যেমন বিএনপি সংস্কার বলতে বোঝে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযাগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ। তাদের কাছে সংস্কার মানে প্রায় দেড় দশক ধরে ভোটবঞ্চিত মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত করা; কিন্তু সংস্কার প্রশ্নে জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় বিএনপির দীর্ঘদিনের ভোট ও জোটসঙ্গী জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। তারা মনে করে, আগে সংস্কার তারপরে নির্বাচন। অর্থাৎ নির্বাচন তাদের কাছে এক নম্বর অগ্রাধিকার নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের অবস্থান মোটামুটি অভিন্ন। তারা মনে করে, শুধু নির্বাচনের জন্য জুলাই অভ্যুত্থানে শত শত মানুষ প্রাণ দেয়নি। অতএব, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ব্যতিরেকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় গেলে তারা সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে কি না, বা কাঙ্ক্ষিত সংস্কার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনীত শত শত মানুষ হত্যার বিচার করবে কি না- তা নিয়ে সরকার ও তাদের অংশীজনদের মনে যেহেতু সংশয় রয়েছে, ফলে তারা তাদের অগ্রাধিকারের তালিকাটি এরকম: ১. বিচার, ২. সংস্কার এবং ৩. নির্বাচন; কিন্তু বিএনপি মনে করে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সংস্কার বৈধতা পাবে না। তার মানে সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। যে কারণে সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের দূরত্ব স্পষ্ট হচ্ছে।

সংস্কারের ‘ষড় ক’

সাংবাদিকতার একটি পরিভাষা ‘ষড় ক’। সাংবাদিকতা প্রাথমিক পাঠে এটি পড়ানো হয়। কোনো একটি ঘটনাকে বুঝতে হলে খবরের ভেতরে ছয়টি কয়ের উত্তর জানার চেষ্টা করা হয়। এগুলো হচ্ছে- কী, কে, কখন, কোথায়, কেন ও কীভাবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলো এভাবে করা যায়। সংস্কার কী, সংস্কার কে করছে, সংস্কারটি কখন হবে, কোথায় হবে, কেন সংস্কার প্রয়োজন এবং সংস্কারটি কীভাবে হবে?

শুরুতেই বলা হয়েছে সংস্কার কী সেটি নির্ভর করে উত্তর কে দিচ্ছেন তার ওপর। অর্থাৎ তিনি সংস্কার বলতে কী বোঝেন- সেটি তার চিন্তা, বোধ, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করে। কেউ হয়তো সংস্কার বলতে বোঝেন যেহেতু গত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি, অতএব, এবার ভোট দিতে চান। তিনি নির্ভয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন; সব প্রার্থীর জন্য নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ থাকবে; ভোটে সরকার ও তার প্রতিষ্ঠাগুলো কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে না; ভোট হবে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাকে ভোট দেবে- তিনি জয়ী হবেন। ভোটের পরে পরাজিত প্রার্থীরা বিজয়ী প্রার্থীর দ্বারা আক্রমণের শিকার হবেন না। আর এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য যেসব সাংবিধানিক, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন- সেগুলো নিশ্চিত করাই তার কাছে সংস্কার।

কিন্তু ফুটপাতে যিনি চা বিক্রি করেন; যাকে দৈনিক পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক মাস্তানকে চাঁদা দিতে হয়; পুলিশ কখন দাবড়ানি দেয়, তা নিয়ে তটস্থ থাকতে হয় তথা সারাক্ষণই একধরনের অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়, তার কাছে সংস্কারের অর্থ ভিন্ন। যদি তাকে ফুটপাতে চা বিক্রির জন্য কাউকে চাঁদা দিতে না হয়; যদি পুলিশ তাকে দাবড়ানি না দেয়; যদি তার জীবন-জীবিকা নিয়ে কোনো সংশয় না থাকে এবং এই সামান্য আয় দিয়েই তিনি যদি তার সংসার চালাতে পারেন এবং এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র যদি কোনো উদ্যোগ নেয়, তার কাছে এর চেয়ে বড় কোনো সংস্কার নেই। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় শেখ হাসিনা, ড. ইউনূস নাকি তারেক রহমান- তাতে তার কিছু যায় আসে না। এমনকি দেশে গণতন্ত্র কতটুকু আছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেও তার ঘুম হারামের প্রয়োজন হয় না।

তার মানে সংস্কার কী- সেটি প্রধানত নির্ভর করে ব্যক্তির জাগতিক প্রয়োজনের ওপর। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে যে মানুষগুলো চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছেন; যাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বা উৎপাদন কমে যাওয়ায় আয় কমে গেছে; মালিক জেলখানায় বা পলাতক বলে যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত- তাদের কাছে গিয়ে আপনি যতই নির্বাচনি সংস্কার, গণহত্যাকারীদের বিচার, নাগরিকের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলুন না কেন, এগুলো তার কাছে অর্থহীন। অর্থাৎ মানুষের জীবিকার অনিশ্চয়তা তৈরি হলে তার কাছে গিয়ে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলা নিরর্থক।

সংস্কার কে করবে?

পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সবার মধ্যেই কমবেশি আছে। একেকজন সংস্কারকে একেকভাবে দেখে- তাও ঠিক; কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো কে করবে? মূলত সরকার। গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণের পরে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। যার মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনি ব্যবস্থা, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগও রয়েছে। বলা হচ্ছে, এই কমিশনগুলো সুপারিশসহ আলাদা আলাদা প্রতিবেদন সরকারকে দেবে। সরকার এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে। তারপর সংস্কার বাস্তবায়নের একটি কর্মসূচি ঠিক করা হবে; কিন্তু মূল আলোচনাটি যেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো, সংস্কার বাস্তবায়নের কতদিন লাগবে এবং একটি অনির্বাচিত সরকার সেই সংস্কারগুলো করতে পারবে কি না। তাদের সেই ম্যান্ডেট আছে কি না।

ধরা যাক সংবিধান সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দেবে, সেগুলো অধ্যাদেশ জারি করে বাস্তবায়ন করা যাবে না। সংবিধানে যেকোনো পরিবর্তন আনতে গেলে হয় গণপরিষদ লাগবে অথবা পরবর্তী সংসদে সেটি করতে হবে। গণপরিষদ গঠনের মতো বাস্তবতা এখন আছে কি না বা এই ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার মানে সাংবিধানিক সংস্কারটি হতে হবে পরবর্তী সংসদে; কিন্তু অন্য কোনো সংস্কার যদি সাংবিধানিক সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তখন সেই পরিস্থিতি বা জটিলতা কীভাবে এড়ানো যাবে?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন না থাকলেও তাদের অদক্ষতা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন, তাদের কতজন রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য তা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তো বটেই, সাধারণ মানুষেও মনেও নানাবিধ প্রশ্ন এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। জাতির যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভরসা। মানুষকে আশাবাদি করে তোলা; কিন্তু গত পাঁচ মাসে দেশের মানুষকে অন্তর্বর্তী সরকারে সংস্কার তথা ইতিবাচক পরির্বতনের ব্যাপারে কতটুকু আশাবাদি করতে পেরেছে- তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা এবং অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের যে অবস্থা- তাতে মানুষ সংস্কারের ব্যাপারে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছে বলে মনে হয় না।

বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন একাত্তরের মহান মু্ক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে যে ধরনের বয়ান তৈরি করা হচ্ছে; ঐতিহাসিকভাব মীমাংসিত অনেক বিষয়কে যেভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে, বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাঠ্যবইতে যে ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা দেশের সাধারণ মানুষ খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বলে মনে হয় না। অনেকের মনে এই প্রশ্নও তৈরি হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাহাত্তরের সংবিধানের বিষোদ্গার এবং এইসব ইস্যুতে নতুন বয়ান তৈরির কী সম্পর্ক? সুতরাং, যারা সংস্কার করছেন বা করবেন বলে বলা হচ্ছে, তাদের ইনটেনশন বা নিয়ত নিয়ে যদি জনমনে সংশয় তৈরি হয়, তাহলে সংস্কারের পক্ষে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। গত পাঁচ মাসেও যে সংস্কার ইস্যুতে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, তার প্রধান কারণ সম্ভবত সরকার ও তাদের স্টেকহোল্ডারদের ‘ইনটেনশন’।

সংস্কার কোথায় হবে?

একজন সাধারণ মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, আপনি কোথায় কোথায় সংস্কার চান- তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে প্রথমেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বলবেন। অর্থাৎ জনগনের ট্যাক্সের পয়সায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় যে কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তিনি যদি কোনো ধরনের হয়রানি, ঘুষ ও সময়ক্ষেপণ ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত সেবাটি পান- সেটি হোক থানা, আদালত, ভূমি অফিস, পাসপোর্ট অফিস কিংবা গ্যাস-বিদ্যুতের অফিস- তাহলে সেটিই তার কাছে সংস্কার। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার হচ্ছে সর্বজনীন প্রত্যাশা; কিন্তু গত পাঁচ মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনো পরিবর্তন কি এসেছে?

পাঁচ মাসে কোনো একটি প্রতিষ্ঠান আমূল বদলে যাবে- সেটি হয়তো অবাস্তব; কিন্তু পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে কি না? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা কি ৫ আগস্টের আগের মানসিকতা নিয়েই কাজ করছেন? তারা আগের মতোই সেবাগ্রহীতাকে তাদের সার্ভেন্ট মনে করেন? তারা কি এখনও স্যার না বললে মাইন্ড করেন? এখনও কি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কোনা সরকারি কর্মকর্তার অফিসে ঢুকতে একজন সাধারণ মানুষের হাঁটু কাঁপে? ঘুষ, হয়রানি ও সময়ক্ষেপণ ছাড়া কি মানুষ সেবা পাচ্ছে বা নাগরিকের হয়রানি ও দুর্ভোগ লাঘবে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ কি নেয়া হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত ‘না’। কেননা এখনো প্রতিনিয়ত সরকারি অফিস, সরকারি হাসপাতালসহ নানা প্রতিষ্ঠানের যেসব খবর গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার বরাতে জানা যাচ্ছে, তাতে এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, সত্যিই কোথাও ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে।

অর্থনৈতিক সংস্কারে ব্যর্থতা দৃশ্যমান

শীতকালীন সবজির উৎপাদন ভালো বলে বাজারে এখন সব ধরনের সবজির দাম যথেষ্ট কম। তাতে সাধারণ ভোক্তারা খুশি হলেও মাঠ পর্যায়ের কৃষক বেজার। কেননা তারা দাম পাচ্ছেন না। কৃষক পর্যায়ে একটা ফুলকপির দাম ২ টাকা বা তারও কম- এমন খবরও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে; কিন্তু মাছ-মাংসের দাম আগের মতোই চড়া। বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাতের উপাদান চালের দাম নিয়েও মানুষ ক্ষুব্ধ। বাণিজ্য উপদেষ্টা যথারীতি এর জন্য দুষছেন সিন্ডিকেটকে। সরকারের বাজারনীতি যদি জনবান্ধব না হয় এবং কৃষকের সুরক্ষায় তার যদি কোনো পরিকল্পনা না থাকে- তাহলে শুধু রাজনৈতিক সংস্কার দিয়ে দেশ এগিয়ে নেয়া যাবে না।

নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য গত অক্টোবর মাসে ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ফলে টিসিবির পরিবার কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন; কিন্তু মাত্র দুই মাস সাত দিন চলার পরে এ কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি। গত অক্টোবরে ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এটিও সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনিয়মের অভিযোগে সারা দেশে টিসিবির এক কোটি পরিবার কার্ডের মধ্যে ৪৩ লাখ কার্ড বাতিল করা হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের কথা ভেবে যেখানে ট্রাক সেলের মতো কর্মসূচি আরও বাড়ানো প্রয়োজন ছিল, সেখানে উল্টো এসব কর্মসূচি বন্ধ বা আওতা কমানোর মতো গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার যে তার অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

ব্যাংকিং খাতে যে নৈরাজ্য চলেছে- সেটি সংস্কারে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে কোথাও কোথাও হিতে বিপরীত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নানা মন্তব্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যে, ওইসব ব্যাংকে এখন আর কেউ টাকা রাখে না। বরং যার ১০ হাজার টাকা জমা ছিল, তিনিও সেই টাকা তুলে ফেলেছেন। ‘দুর্বল ব্যাংক’ তকমা দেয়ার কারণে ব্যাংকগুলো এখন প্রায় দেউলিয়া। অথচ জাতির একটি সংকটকালে সরকারের উচিত ছিল মানুষের মনে আস্থা ও ভরসা তৈরি করা। কিছু ব্যবসায়িকে টার্গেট করার মধ্য দিয়ে পুরো ব্যবসা-বাণিজ্যে একটা ভয়ের আবহ তৈরি করা হয়েছে। ভয় নিয়ে ব্যবসা হয় না। বলা হয়: ‘ইকোনমি নাথিং বাট হোপ’; কিন্তু সরকার এই হোপ বা আশাবাদ তৈরি করতেই ব্যর্থ হয়েছে। যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলোর মালিক বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন; কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মীদের কী অপরাধ?

ব্যবসা বা উৎপাদন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষকে বেকার বানিয়ে কিংবা তাদের এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে দেশের কী লাভ হলো? গ্যাস সংকট, জ্বালানির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা, অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে ভ্যাট বাড়ানো, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের নামে নানাবিধ জটিলতায় আটকে দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকার তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চায় বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। তাতে করে নতুন কোনো বিনিয়োগ তো হবেই না, বরং পুরোনো বিনিয়োগকারীরাও পালানোর পথ খুঁজবে। তো সব ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী চলে গেলে দেশের অর্থনীতির কী হবে- সেটা সরকার ও তাদের স্টেকহোল্ডাররা বোঝেন কি না- তা নিয়ে সন্দেহ আছে। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে তারা কী সংস্কার করবেন বা সেই সংস্কার দিয়ে কী হবে, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে প্রায় একশো পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এটি একটি বিরল ঘটনা। ভ্যাট বা পরোক্ষ কর বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাবে। তাতে স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়বে। অথচ তাদের প্রত্যাশা ছিল এই সরকার তাদের জীবনযাপনের ব্যয় কমাতে ভূমিকা রাখবে; কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ