Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট স্বাস্থ্য খাত অর্জন, প্রস্তুতি ও সম্ভাবনা

Mamun Al Mahtab  Shwapnil

মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩

ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে সফল যাত্রা শেষে বাংলাদেশের পরবর্তী গন্তব্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ। আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাস্তবায়নকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশিত পথ ধরে আমাদের সব রাস্তা এখন ওই একমুখী। সঙ্গত কারণেই স্বাস্থ্য খাতও এর বাইরে নয়। আমার মনে হয়, যে কেউই আমার সঙ্গে একমত হবেন, কোনো দেশ যখন ডিজিটালাইজেশনের পথে হাঁটতে শুরু করে, তখন সেই যাত্রার শুরুটা সাধারণত হয় স্বাস্থ্যসেবার আঙিনা থেকে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা ব্যতিক্রম, হয়তোবা আমাদের স্বাস্থ্য খাত এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়েই পড়া।

হালের কালাজ্বর নির্মূল থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে ভূমিধস বিজয় আর তারও আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পদক অর্জন- এসবই আমাদের স্বাস্থ্য খাতের একেকটা মাইলফলক। তবে যে ক্ষেত্রে অতিপারঙ্গমতা আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে বিশ্বে একেবারে সামনের কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং পাশাপাশি জাতিকে করেছে গর্বিত, তাহলো কভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন। বাংলাদেশ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে ৩টি দেশের একটি দেশ, যারা এক দিনে ১ কোটি নাগরিককে কভিডের ভ্যাকসিনের একটি ডোজ দিতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে কি না পৃথিবীতে কমপক্ষে ১ কোটি জনসংখ্যার দেশের সংখ্যা ৯০টিরও বেশি। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের এই সাফল্য ভাগ বসাতে পারে শুধু আমাদের দুই অতি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীন। তারপরও আমার বিবেচনায় আমাদের এই সাফল্য ভারত এবং চীনের সাফল্যকেও ছাপিয়ে যাওয়ার মতোই। কারণ এই দুটি দেশের প্রত্যেকেরই হাতে ছিল নিজেদের উৎপাদিত একাধিক ভ্যাকসিন। সেই জায়গাটায় আমরা একেবারেই অনন্য। আমাদের নিজস্ব কোনো ভ্যাকসিন না থাকা সত্ত্বেও ১ কোটি মানুষকে এক দিনে কভিড ভ্যাকসিন দিয়েছি। শুধু তাই-ই নয়, বরং কভিডের একেবারে শুরুর দিক থেকেই দেশের সিংহভাগ মানুষকে আমরা বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। আর এ সবই নিঃসন্দেহে স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী একটি স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা খাতেরই ইঙ্গিতবহ।

এতসব অর্জনের প্রেক্ষাপটে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে এখনো কেন আমাদের প্রতিটি হাসপাতাল ডিজিটালাইজড নয়? কেন এখনো আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়- সব হাসপাতালের প্রতিটি রোগীর সব তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নয়? দেশের সব নাগরিকের যখন ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে, আমার মতো সাধারণ একজন নাগরিক যখন ই-চিপ লাগানো বাংলাদেশ পাসপোর্ট স্ক্যান করে সোজা হেঁটে পেরুতে পারি নারিতা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন। তাহলে এখনো কেন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ওপিডি বা ইনডোরে বসে আমাকে প্রেসক্রিপশনে কলম পিষতে হয়? তবে এর বিপরীতেও কথা আছে। নিঃসন্দেহে এসব জায়গায় আমাদের অগ্রগতিও একেবারেই কম নয়। এই সেদিনই তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে বসে দেশের ১০০টি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন। এটা কম কথা নয়, যেমন কম কথা নয় বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোর বেডসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজারে উন্নীত করা। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডবল ডিজিটসংখ্যক বিশেষজ্ঞ পদায়নের পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা। আবার দেশের প্রায় প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউনিট-২ প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগের যে কোনো ঘোর নিন্দুকও নিশ্চই অস্বীকার করবেন না যে, বিশ্বের বৃহত্তম বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি রোগের জন্য জাতীয় পর্যায়ের ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা কিংবা দেশের ৮টি বিভাগীয় সদরে ক্যান্সার, হৃদরোগ আর ট্রমার সর্বাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা স্থাপন করা অথবা দেশের প্রতিটি হাসপাতালকে আধুনিকতম চিকিৎসা সরঞ্জামে সজ্জিত করাটাও কম কথা নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সদ্য সংযোজিত সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটিতে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছে রূপান্তরিত হয়নি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। পাশাপাশি এমন ব্যবস্থা দেশে তো বটেই, কোনো বিদেশি চিকিৎসক বা বিদেশি হাসপাতাল এক্সিকিউটিভও আমার এখনো চোখে পরেনি। কাজে এটিও নিশ্চয়ই কম কথা নয়।

এত কিছুর পরও স্মার্ট বাংলাদেশের দৌড়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাত এখনো হিটে কোয়ালিফাই করে চূড়ান্ত দৌড়ে অংশগ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, তা নিয়ে অনেকেই হয়তো একমত হবেন, আবার কেউ কেউ হয়তো না। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে রাখঢাক রাখেন না, প্রায়ই কখনো হতাশা, কখনো ক্ষোভ প্রকাশ করেন দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানচর্চায় অপ্রতুলতা নিয়ে, কাজেই আমারও খামোখাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা-ঢাকির প্রয়োজনটা কী? এর ব্যাখ্যাটা হয়তো একেক জনের কাছে একেক রকম। আমার কাছে যেমনটি মনে হয়, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অগ্রগতিগুলো হয়েছে অবকাঠামোগত এবং ভৌত বিনিয়োগকেন্দ্রিক। আমরা স্বাস্থ্য খাতে একের পর এক আধুনিক হাসপাতাল বিল্ডিং যোগ করেছি আর সেসব ভরে দিয়েছি আধুনিক সব যন্ত্রপাতি দিয়ে; কিন্তু অন্য আরেকটি জায়গায় আমাদের বিনিয়োগটা রয়ে গেছে অপ্রতুল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন যে কোনো উন্নয়নযজ্ঞেরই অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু একইভাবে দক্ষ জনশক্তি আর মেধাচর্চার সুস্থ পরিবেশ তৈরিতে বিনিয়োগটাও জরুরি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটা না আমরা তৈরি করেছি, না মহাকাশে উড়িয়েছি; কিন্তু এখন তার পরিচালনা পুরোপুরি আমাদের বিশেষজ্ঞদের হাতে। একই ঘটনা কদিন পরে ঘটবে রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের বেলাতেও, যেমনটি ঘটেছে ঢাকা মেট্রো রেল কিংবা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে আর সামনে ঘটতে যাচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর কিংবা পদ্মা সেতু আর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষেত্রেও। শুধু স্বাস্থ্য খাতেই কেন যেন এ জায়গাটায় পিছিয়ে থাকা, যদিও এই খাতটিতেই আমাদের বিশেষজ্ঞ তথা, অতি দক্ষ মানবসম্পদ, অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও এই যে গতিজড়তা, তার কারণটা সম্ভবত সঠিক জায়গার নেতৃত্বে সঠিক মানুষগুলোর অনুপস্থিতি।

চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্যসেবা এতটাই সুপার স্পোশালাইজড, সেখানে একজন লিভার বিশেষজ্ঞের মনস্তত্ব আর ক্রিয়া-বিক্রিয়া এবং চাহিদাগুলো বোঝা একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেই দুষ্কর। কজেই ভিন্ন পেশার কোনো কর্মকর্তা, তা তিনি প্রশাসনে যতই দক্ষ হন না কেন, তার পক্ষে বুঝে-শুনে ঠিকমতো হালটা ধরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কঠিন। আমাদের কৃষি খাতে বিজ্ঞানচর্চা থেকে শুরু করে স্মার্ট যাত্রায় অগ্রগতি বহুল প্রশংসিত এবং আমার মতো চিকিৎসকের কাছে অনেক সময় ঈর্ষণীয়। তবে এর কারণটাও বোধকরি স্পষ্ট। এই খাতের প্রতিটি জায়গার নেতৃত্বে আছেন স্বপেশার মানুষগুলো। কৃষি নিয়ে যিনি গবেষণা করেন, তিনি যেমন কৃষিবিদ, তেমনি তার আবিষ্কারটিকে আস্থায় নিয়ে যিনি উদ্ভাবিত এবং অতঃপর উৎপাদিত পণ্যটিকে বাজারে নিয়ে আসেন তিনিও কৃষিবিদ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে প্রশাসনের যেসব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি কৃষিতে উদ্ভাবন থেকে উৎপাদন- এই পুরো প্রক্রিয়ার তদারকি ও বাস্তবায়ন দেখভাল করেন, তারাও অনেকেই কৃষিবিদ।

অন্যদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন সমন্বয়ের কোনো সুযোগ তো নেই-ই, বরং আমরা কেউ যদি কালে-ভদ্রে কখনো কোনো উদ্ভাবনের দাবি করেও বসি, তার সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করেই বরং তা ভুল প্রমাণের উৎসবে মাতেন বাইরের অন্য কারও আগে, আমাদের পেশার মানুষগুলো। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত এমআরএনএ কভিড-১৯ ভ্যাকসিনটির বানর এবং মানুষের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোর প্রধান গবেষক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা তেমনটাই। তবে আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় কিংবা বলতে বলা হয়, স্মার্ট বাংলাদেশ থেকে আমাদের স্বাস্থ্য খাত কতদূর, আগামী স্মার্ট বাংলাদেশে থাকবে যে স্বাস্থ্যসেবা খাত তা কি শুধু ডিজিটালই হবে, নাকি হবে স্মার্টও, তাহলে চোখ বন্ধ করে আমি আমার ভোটটা দিব স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা খাতের দিকে। ‘সবজান্তা শমসের’ টাইপের একজন মানুষ হিসেবে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির সুবাদেই শুধু নয় বরং একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে আমার সব যুক্তিই আমাকে এমন শেখায়।

কেউ কেউ বলেন কভিডের কারণে আমাদের না কি বেশকিছু ভালো অর্জনও রয়েছে। যেমন সেদিন এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রীকে বলতে শুনলাম, কভিডের কারণে ই-কমার্স খাতে আমাদের অগ্রগতির কথা। তবে আমার মনে হয়, কভিডের কারণে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনটা বোধ করি হয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য খাতেই। ১৯৭৫ পরবর্তী ২১ বছরের জঞ্জাল দূর করে দেশটাকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিতেই কেটে গেছে প্রধানমন্ত্রীর পরপর দুই টার্মের প্রায় পুরোটাই। তৃতীয় মেয়াদে এসে কভিডের কল্যাণে তার পুরো ফোকাস এখন স্বাস্থ্য খাতের দিকে। আর এটা তো বলাই বাহুল্য, এই মহীয়সী নারী যখন যেদিকে নজর দিয়েছেন সে খাতে এদেশের অর্জনগুলো দেশের সীমানা পেরিয়ে নজর কেড়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও।

আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। সম্প্রতি আমার সুযোগ হয়েছিল দেশের একটি হাসপাতালে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন চালু করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘণ্টাখানেক আলোচনা করার। শুরুতে আমাদের জন্য ১৫ মিনিটের মতো সময় বরাদ্দ থাকলেও আলোচনা শেষ হতে হতে ঘড়ির কাঁটা ঘণ্টা পেরিয়েছে। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, তিনি কীভাবে খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করলেন, নিজের সিদ্ধান্ত কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেই পুনর্বিবেচনা করলেন এবং সবশেষে কি দারুণ একটি রোডম্যাপ আমাদের দিয়ে দিলেন। অতএব, আমি যখন স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট স্বাস্থ্য খাতের পক্ষে আমার ভোটটা দেওয়ার কথা লিখি, তখন আমি তা বুঝে-শুনেই লিখি। আর আমিই বা কোন ছাড়? এ কথা তো বলছে আজ গোটা বিশ্বই। স্বাস্থ্যখাতে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ব্যক্তির নামে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করল। আর বহুল আলোচিত এই রেজুলেশনটিতে জাতিসংঘ স্পষ্টতই তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে, তারা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলটি অর্জন করতে চায়, তবে তাদের অবশ্যই শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিকের কনসেপটি ধারণ ও গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ