উদ্বোধনী সংখ্যা ১ : স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য স্মার্ট মানুষ প্রয়োজন
বাংলাদেশ বিগত এক যুগে বিস্ময়কর আর্থ-সামাজিক উন্নতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের এই অর্জন আন্তর্জাতিকভাবেও নন্দিত। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়। এ ছাড়া, এই সময়ে দারিদ্র্য, শিশু মৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, খর্বাকৃতি শিশুর হার হ্রাস এবং নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব উন্নতি অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশে। চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশে রূপান্তর করা এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যুক্ত করা।
একই সঙ্গে স্মার্ট ও কল্যাণ রাষ্ট্রে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ধারাবাহিকভাবে বিগত একযুগ ধরে রাষ্ট্রীয় নীতি-কাঠামো অনুকূল থাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ (কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপক ইত্যাদি) শ্রম দিয়ে নিজেদের এবং দেশের অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন। আগামীতেও যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, তাহলে উন্নয়নের জন্য যেসব ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সে পথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। যে দেশের মানুষ দেশকে দখলদারমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে সে দেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বের এবং অনুকূল পারিপার্শ্বিকতার।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি বিশেষ অঙ্গীকার ছিল, তা হচ্ছে ‘অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা। বর্তমানে দেশে বাস্তবায়নাধীন টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচির একটি প্রধান নৈতিক তাগিদ হচ্ছে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেকে কাউকে বাদ দেয়া যাবে না বা পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও অংশ। বঙ্গবন্ধুর নিমর্ম হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়। এই একুশ বছরের উন্নয়নের চিত্র অনুজ্জ্বল। দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান ছিল। এই খাদ্য ঘাটতি দূর করার লক্ষ্যে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শেখ হাসিনা সরকার। উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা আপত্তি জানায়; কিন্তু সঠিকভাবেই তা মানা হয়নি। ফলে বাংলাদেশ ২০০০ সাল নাগাদ দনাদার খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর ২০০১ সাল থেকে সেরকম সহায়তা না দেয়ায় কৃষি খাতে সূচিত অগ্রগতি সেভাবে সচল থাকেনি। তাই বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশই থেকে যায়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল আবার ক্ষমতায় এসে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে উন্নতি সাধনে তৎপর হয় এবং সেই লক্ষ্যে নীতিগত এবং প্রণোদনাভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। তখন দেশে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিরাজমান ছিল। আর এখন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে আবাদি জমির পরিমাণ নানা কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তারপরও দেশজ উৎপাদন থেকে দানাদার খাদ্যের সার্বিক নিরাপত্তা মোটামুটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। কৃষি খাতে এই ব্যাপক সাফল্যের কারণেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন (যেমন কভিড-১৯ মহামারিকালে) খাদ্য সংকট দেখা দিলেও বাংলাদেশ সেই সংকট থেকে মুক্ত থাকতে পারছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে তার পেছনে কম খাদ্য উৎপাদন দায়ী নয়। খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় নানা সমস্যা এক্ষেত্রে একটি কারণ।
এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতও দেশে বর্তমান মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী, তবে তা এখন আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় কেননা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেসব পণ্য আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমাদানি করি সেগুলোর মূল্য ইউক্রেন যুদ্ধ-পূর্ববর্তী স্তরে বা কাছাকাছি কয়েক মাস আগেই নেমে এসেছে। কাজেই বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য অভ্যন্তরীণ বিপণন ব্যবস্থায় ঘাটতি ছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুষ্ট চক্রের উপস্থিতি এবং অবৈধ অর্থ অর্জনে তৎপরতা বিশেষভাবে দায়ী বলে আমার মনে হয়। ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে দুষ্ট চক্রগুলোর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে সফলতা আসবে এবং তার ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আমি মনে করি।
বর্তমান বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহর থেকে গ্রাম দেশের সর্বত্রই তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারিত হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও অনেকেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তাদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলছেন। ভালো উপার্জন করছেন। এদের সংখ্যা ও কাজের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব কমিয়ে আনতে এই খাত ভূমিকা রাখছে। এ খাতে সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারণে সরকারের নানা উদ্যোগ রয়েছে। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কল্যাণ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ নানা কাজের মধ্যে রয়েছে: সামাজিক বৈষম্য হটানো, সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা এবং মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মানুষের মধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রোথিত করা। এসব বিষয়ে উদ্যোগ এবং কর্মসূচি আরও বাস্তবতাভিত্তিক হতে হবে, জোরদার করতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে, যতদিন না সন্তোষজনক সাফল্য অর্জিত হয়। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চারটি স্তম্ভ চিহ্নিত করা রয়েছে। প্রথমত স্মার্ট নাগরিক। অর্থাৎ দেশের সব নাগরিককে স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট বলতে এখানে এমন একজন নাগরিককে বোঝানো হয়েছে, যিনি আধুনিক জ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যায় এবং মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হবেন। দ্বিতীয়ত, স্মার্ট সমাজ গড়ে তুলতে হবে। অবশ্যই এমন সমাজের সদস্যরা স্মার্ট হবেন। তবে এখানে সমাজভুক্ত মানুষদের নিজের ও সবার উপকার যাতে হয়, তার জন্য উন্নতমানের সামাজিক রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতির প্রসার প্রয়োজন হবে।
তৃতীয়ত বলা হয়েছে অর্থনীতি হবে স্মার্ট। অর্থনীনিতে বিভিন্ন খাত ও উপখাত রয়েছে। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিভন্ন মাত্রায় পরস্পর সম্পর্কিত। বিভিন্ন গভীরতার এ সব পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে বিবেচনা নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। অন্যথায় যে কোনো ক্ষেত্রে কোনো লক্ষ্যভুক্ত অর্জনের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ অন্য কোথাও বিরূপ প্রভাব যে ফেলতে পারে, তা গৃহীত কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাবে। উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে ক্রমাগত হ্রাস নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমদানি ব্যয় হ্রাসের ওপর জোর দেয়া হয়; কিন্তু এতে দেখা গেলো অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানিও কমে যায়; ফলে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে উৎপাদন এবং দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কমে যাবার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগে আমাদের ভাবতে হবে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হলে অন্য কোনো খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না এবং সেরকম সম্ভাবনা থাকলে তা উপশমের ব্যবস্থা করতে হবে, গৃহীতব্য কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থায়।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ধারাবাহিক গতিশীলতা সূচিত হয় ২০১০ সালে। পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি হয়। কভিড-১৯ মহামারিকালে ধাক্কা খেলেও, পরে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ধারা শক্তি সঞ্চয় করে। স্মার্ট অর্থনীতির ধারণার আওতায় বাংলাদেশ অর্থনীতিতে বিকাশ যাতে আরও দ্রুত ঘটে এবং দেশের সব নাগরিক যাতে ন্যায্যভাবে অংশীদার হকে পারেন সেদিকে নজর দিতে হবে। চতুর্থ স্তম্ভ হচ্ছে স্মার্ট সরকার। উন্নত স্মার্ট কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই সরকারকে সেই বিবেচনাগুলো ধারণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এখানে প্রয়োজনীয় করণীয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, দুর্নীতি দমন, বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান দুষ্টচক্র হটানো, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য নিরসন, ব্যাংকিং ও বিভিন্ন আর্থিক উপখাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, সর্বজনিন স্বাস্থ্যসেবা প্রথা চালু করা, শিক্ষা খাতে ঘাটতি দূর করে সাবলীলতা জোরদারকরণ, তরুণ প্রজন্ম যাতে নৈতিকতা ও দক্ষতায় বলিয়ান হয়ে চাহিদামতো পেশায় সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব স্তরে ও আঙ্গিকে নারীর যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, গৃহীত সব কর্মসূচি ও প্রকল্পের কার্যকর ও সময়মতো বাস্তবায়ন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা এবং স্মার্ট কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন খাতে যথাযথভাবে দীক্ষিত উপযুক্ত নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। এসব ব্যবস্থা যথাযথভাবে বিন্যাস ও বাস্তবায়ন করে উন্নত স্মার্ট কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার পথ রচনা এবং সেপথে দৃপ্ত পদে এগিয়ে চলার জন্য উপযুক্ত মানুষ চাই। এখানে স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই।’ এটাই আসল কথা। অর্থ্যাৎ যেসব লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে সেগুলো অর্জনের পথে এগিয়ে চলতে হলে সেরকম মানুষ চাই, নেতৃত্ব দেয়া এবং বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করার জন্য।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে