Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

গাজী টায়ার কারখানায় আগুন

মাইকে মিছিলের ঘোষণা দিয়ে হামলা, লুট

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী গাজী গ্রুপের গাড়ির টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানা গাজী টায়ারসে গত রোববার আগুন দেওয়ার আগে মাইকে মিছিলের ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়। এরপর চালানো হয় হামলা, করা হয় লুটপাট।

জানা গেছে, রোববার ভোররাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসা থেকে গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ খবর তার নির্বাচনী এলাকা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়লে সকাল থেকেই সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷ দুপুরের দিকে কারখানাটির অদূরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয়। এ ঘোষণার পর কয়েকশ মানুষ জড়ো হন কারখানাটির সামনে, শুরু হয় লুটপাট৷ দিনভর লুটপাটের পর রাত ৯টার দিকে কারখানাটির ভেতরের একটি ভবনে আগুন দেয় একদল দুর্বৃত্ত।

হামলায় ভাড়টে ও বাইরের মানুষ
জানা গেছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কারখানায় প্রথমবার হামলা হয়। ২৫ আগস্ট হামলা হয় দ্বিতীয়বারের মতো। এই হামলায় স্থানীয়রা খুব কম জড়িয়েছে। অধিকাংশ ছিলো ভাড়াটে ও বাইরের মানুষ।

বিষয়টি নিয়ে মো. আওয়াল হোসেন নামের একজন বলেন, ৫ তারিখে প্রথমবার আশেপাশের নানা জায়গার মানুষজন আনন্দ মিছিল করতে করতে কারখানায় ঢুকে পড়ে। তখন কারখানায় যদি বিস্ফোরণ ঘটে তবে আশেপাশে দুই কিলোমিটার এলাকা উড়ে যাবে- এমন কথা ছড়িয়ে যায়। এ কথা শুনে আমি গ্রামের পূর্ব দিকে চলে যাই।

তিনি বলেন, রোববার গাজী ধরা পড়ার খবরে দুপুরে আনন্দ মিছিল হবে বলে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। বিকেলের দিকে মিছিলটি কারখানায় ঢোকে। নয়টার দিকে আমরা আগুনের খবর পাই।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয়রা খুব কমই এসবে জড়িয়েছে। বেশি ছিলো ভাড়াটে এবং বাইরের মানুষ। আশেপাশর ২০ থানার মানুষ এসেছিলো বলে দাবি করেন তিনি।

গাজী টায়ারসের নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ৫ তারিখে হামলাকারীরা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা পেয়ে ২৫ তারিখে ফের হামলা করেছে।


ভবনের দাহ্য পদার্থ ও ভারি মালামাল থাকায় অনেকেই হয়তো সেগুলো নিয়ে নিচে নামতে পারেনি। তাছাড়া ফারার সার্ভিসকে আগুন লাগার খবর দিলেও রূপসী মোড়ে জ্যামের কারণে তাদের আসতে দেরি হয়।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মান্নান জানান, তারা আগুন নেভানোর সময় বেশ কয়েকবার বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছেন। এমনকি চতুর্থ এবং পঞ্চম তলার ছাদের কিছু অংশে ধসে পড়েছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

হামলা প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেনি স্থানীয়রা
তবে হামলা বা লুটপাট প্রতিহতের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।তারা বলছেন, ক্ষমতার দাপটে 'পানির দামে' স্থানীয়দের কাছ থেকে জমি কিনে টায়ার কারখানা করলেও এলাকার মানুষকে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এতে কারখানাটির মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রতি মানুষের ক্ষোভ ছিলো।

মো. আওয়াল হোসেন নামের ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ বুধবার বলেন, কারখানার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ডোবার সামনে এক কানি (৩০ শতাংশ) জমির ওপর আমার ঘর ছিলো। এই জমি কিনে নিতে এমপি সাহেব লোক দিয়ে মাত্র ১২ লাখ টাকা পাঠায়। বিক্রি না করে উপায় ছিলো না। বাধ্য হয়ে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে টাকা নিয়েছি।

তিনি বলেন, তখন বিক্রি করে না দিলে আজ দখল নিতে পারতাম।

খাদুন গ্রামের মো. মোবারককে একটি জমিতে কাঁটাতারের বেড়া দিতে দেখা যায়। জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাজী সাহেব সরকারের লোক ছিলো তাই কিছু করতে পারিনি। এখন তো সেই সরকারও নাই। তাই আমি জায়গা বুঝে নিচ্ছি।

একই কথা বলেন আরো অনেকেই। কারখানার উত্তর-পূর্ব দিকের একটি জমিতে সাইনবোর্ড দখা যায়। সাইনবোর্ডে থাকা নাম্বারে কল দিলে শাহ আলম নামের একজন জানান, যদি গাজী কর্তৃপক্ষ এই জমির যথাযথ মূল্য দেয় তবে তারা এ জায়গা ছেড়ে দেবে, আর যদি না দেয় তবে দখলে নেবে।

তদন্ত কমিটি গঠন
এদিকে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে ১০ দিনের মধ্য রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হামিদুর রহমানকে। তিনি জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে, উত্তাপ আছেই
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আনোয়ারুল হক জানিয়েছেন, বুধবার বিকালেই আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। তবে উত্তাপ এখনো আছেই। তাছাড়া ভবনটি তীব্র ঝুঁকিপূর্ণও বলছেন তিনি।

তিনি বলেন, ভবনটি নাজুক অবস্থায় থাকায় সম্পূর্ণ ভেতরে ঢুকে উদ্ধার অভিযান শুরু করা যায়নি। ভেতরের উত্তাপ থেকে আবারো আগুন লাগার শঙ্কা রয়েছে। ভবন বেঁকে গেছে।

নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা
এদিকে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কতোজন মারা গেছেন তা জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস বা অন্য কোনো সংস্থা। এমনকি নিখোঁজের সঠিক সংখ্যা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।

ঘটনার পরদিন সোমবার স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্তত ১৮৭ জন নিখোঁজ আছেন। তবে তারা কোনো তালিকা করেনি।

তবে নিখোঁজের একটি তালিকা তৈরি করেছেন মহিমা মীর রিপা নামের একজন। তার দাবি, তিনি স্বেচ্ছাসেবী। রিপার করা তালিকা অনুযায়ী, এখনো নিখোঁজ ১৩২ জন।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, রূপগঞ্জ থানা পুলিশকে তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তালিকা তৈরি করে এ ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হবে।

বাঁচার জন্য আকুতি
শাহিন আহমেদ নামের স্থানীয় একজন জানান, তারা এসে দেখেন ভবনের সবগুলো শাটার বন্ধ এবং সিঁড়ির গেট কেউ লাগিয়ে দিয়েছে। ভিতরে তখন আগুন। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের সাথে মই ছিলো না। আজিজ নামের স্থানীয় একজন দড়ি ছুড়ে দিলে ৫ তলা থেকে ১৪ জনের মতো বের হতে পেরেছে।

রাহাত ভুইয়া নামের এক তরুণ বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসে। আটকে পড়া লোকগুলো রাত ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত সাহায্যের জন্য চিৎকার করেন। মোবাইলের লাইট জ্বেলে নিজেদের অবস্থানও জানায় অনেকে। কিন্তু কারো পক্ষেই তখন সাহায্য করা সম্ভব হয়নি। দুইটার পরে আর কাউকেই সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে দেখা যায়নি।

স্বজনদের অপেক্ষা
ভবনে আটকে পড়াদের জন্য বুধবারও অপেক্ষা করতে দেখা গেছে স্বজনদের। নিখোঁজ শাহরিয়ার অপুর খোঁজে আসেন তার বাবা অমর আলী। তিনি জানান, তার ছেলে সোয়েটার গার্মেন্টস কর্মী। সে তার দুই মামা মুন্না এবং নজরুলের সাথে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিতে আসে। মুন্না বের হতে পারলেও অপু এবং নজরুল আসতে পারেনি।

তিনি বলেন, এখানে নাকি অনেক কেমিক্যাল আছে। তাই লাশ নাও পেতে পারি। তবুও আসি যদি লাশটা পাওয়া যায়।

নারায়ানগঞ্জ রুপসীর সালেহা বেগমের ছেলে নুর আলম এখনো নিখোঁজ। তিনি বলেন, 'এতোদিনেও পাই নাই। হয়তো আমার বাজান বাঁইচা নাই। তবুও যদি লাশটা পাই। কবরটা তো দিতে পারবো।'

কারখানা খোলায় অনিশ্চয়তা
হামলা, লুটপাট ও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত গাজী টায়ারস কারখানা কবে খোলা হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, কারখানা কবে খোলা হবে এখনি তা বলা যাচ্ছে না।

তারা বলছে, কারখানা বন্ধ হলে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক, কর্মচারী এবং কর্মকর্তার পরিবার বিপদে পড়বে।

গাজী গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজার রফিকুজ্জামান বলেন, আমরা এই মাসের স্যালারি পরিশোধ করে দেব। কিন্তু তারপরে কি হবে জানি না। চেয়ারম্যান স্যার (গোলাম দস্তগীর গাজী) যেহেতু এখন সমস্যায় আছেন তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।

তিনি বলেন, তবে এতোদিনের কষ্টে গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠানকে তো এভাবে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। তাই আমাদের চেষ্টা থাকবেই। কিন্তু এই প্রক্রিয়া লম্বা সময় নিতে পারে।

অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে আইন পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে গাজী টায়ারসের নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ৫ তারিখে হামলার বিষয়ে গত ২০ আগস্ট রুপগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। ২৫ তারিখের ঘটনায় এখনো যেহেতু উদ্ধারকাজ শেষ হয়নি, তাই এ বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

উদ্ধার অভিযানের সর্বশেষ তথ্য
গাজী টায়ারসে আগুনের ঘটনার চার দিন পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত ছয়তলা ভবনটিতে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস৷ ভবনটির অবস্থা ‘অনিরাপদ’ থাকায় উদ্ধার অভিযান শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা৷

বিকালে প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি কারখানাটি পরিদর্শন করে জানিয়েছে, উদ্ধার অভিযানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বৃহস্পতিবার৷

স্থানীয় জনবলের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান চালানোয় সক্ষম না হলে জাতীয়ভাবে অভিজ্ঞদের সহযোগিতা চাওয়া হবে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ দলকে ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়ছেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান৷

নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ছাইফুল ইসলাম বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, আগুন নেভানো গেলেও ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে৷ এ ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না৷ বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল বৃহস্পতিবার আসবে৷ তারা সিদ্ধান্ত দেবেন৷

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ