কক্সবাজারে চোরাচালান স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের জন্য হুমকি
কয়েক সপ্তাহ আগে কক্সবাজারের নিরাপত্তা বাহিনী তিন ব্যক্তিকে কিছু খাদ্য পণ্যসহ আটক করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে ভোজ্যতেল, চিনি এবং মসলা। যেগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে পাঠানোর কথা ছিল। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রমজান মাসে পণ্য মজুদ ও মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মজুদ ও কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি কোনো নতুন ঘটনা নয়, রমজান মাসে মূল্য আরও বাড়ে। রমজান এলেই মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে থাকে, কখন কোন পণ্যের মূল্য বাড়ে, তা নিয়ে। এর মধ্যে এখন বাড়ছে চোরাচালানের শঙ্কা। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রাপ্ত তথ্য মতে, সাম্প্রতিককালে চোরাচালান উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মাধ্যমে মিয়ানমারে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল এবং খাদ্যপণ্যের পাচার হচ্ছে। তবে, কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাচার রোধে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বেশ কয়েকটি অপারেশন চালিয়ে ২৮ জন পাচারকারী আটক করেছে। জব্দকৃত সামগ্রীর মধ্যে ছিল ৭ হাজার ৬৩৬ লিটার অকটেন, ১৩৬ লিটার ডিজেল, এবং ৩ হাজার ৭৫২ লিটার সোয়াবিন তেল, যেগুলো মিয়ানমারে পাচার করার কথা ছিল। সাম্প্রতিক কয়েক দফা অভিযানে, জানুয়ারির ১৩ তারিখে র্যাব কক্সবাজারে ৬ পাচারকারীসহ ২ হাজার ৯০০ লিটার অকটেন আটক করে। ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে কোস্টগার্ড টেকনাফে আটক করে ১৯ জন পাচারকারী। এ অভিযানে কোস্টগার্ড ১ হাজার ৮২১ লিটার অকটেন, ৩ হাজার ৭৫২ লিটার সয়াবিন তেল, ১৩৬ লিটার ডিজেল চোরাকারবারীদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করে। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ পুলিশ টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন থেকে একজন পাচারকারীসহ ১ হাজার ৫০০ লিটার অকটেন আটক করে। এগুলো কেবল গোচরে আসার হিসাব। অগোচরে আরও কত কিছু হচ্ছে কে জানে!
বাংলাদেশ থেকে পণ্য চোরাচালান দেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোরাচালানের বহু তথ্য পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২০০৯ সালে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য, যেমন, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন এবং চাল টেকনাফ এবং উখিয়া উপজেলার ২৩টি সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার পাচার হচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে ইয়াবা, মাদকদ্রব্য, যৌনবর্ধক জিনিসপত্রসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ দ্রব্য। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫টি সিন্ডকেটের প্রায় ১৮০ জন পাচারকারী কোটি টাকার বাণিজ্যে লিপ্ত সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে। কিছু পণ্য নিরাপত্তা বাহিনী উদ্ধার করলেও বেশিরভাগ পণ্যই নিরাপদে পাচার হয়ে যায়।
অতি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে জানা যায়, সমাজকল্যাণ সংস্থা (AOSW) মিজোরামের সামাজিক কল্যাণ সংস্থাকে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অবৈধ চোরাচালান সম্পর্কে রিপোর্ট করেছে। AOSW এর মতে, এসব প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে আছেন গবাদি পশু, ওষুধ, চাল, চিনি, বাদাম, পোশাকসামগ্রী ইত্যাদি। দুর্বৃত্তরা প্রতিবেশী দেশে এসব বিপুল পরিমাণে পাচার করছে। ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের লোকরা প্রতিদিন তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লবণ, চিনি, জিরা এবং গুঁড়ো দুধের মতো সাধারণ পণ্য পাচার করে। দৈনন্দিন এইসব পণ্যগুলো বাংলাদেশে দুষ্প্রাপ্য এবং ব্যয়বহুল; কিন্তু ভারতে সহজলভ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে চোরাচালানই অনেকের পেশা। এসব থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ থেকে অনেক পণ্য যেমন চোরাচালান হয়ে মিয়ানমার যায়, তেমনি ভারত থেকে অনেক পণ্য চোরচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চোরাচালান দেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চোরাচালান একটি কর ফাঁকির কাজ। এটি সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করে। ফলে জনগণ সরকারি ব্যয় থেকে বঞ্চিত হয়। আইনসম্মতভাবে বাজারে আসা পণ্যের চেয়ে চোরাকারবারীর পণ্য কম মূল্যে পাওয়া যায়। চোরাচালান ব্যবসায়ীদের অবাধ প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত করে। চোরচালান অযাচিত প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, ফলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম কমে যায়, এতে স্থানীয় বাজার ধ্বংস হয়। চোরাচালান স্থানীয় শিল্পগুলো পতনের দিকে নিয়ে যায়। এতে দেশের প্রবৃদ্ধি অনিবার্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চোরাচালানের ব্যাপারে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করলেও বড় ধরনের কিছু ফাঁকিঝুকি রয়ে গেছে। সীমান্তের ওপারে, বিশেষ করে রাখাইন অঞ্চলের সাম্প্রতিক অরাজকতা জটিলতা বাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে সংঘাত বাড়ায় একদিকে চাহিদাও যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে নিরাপত্তার জন্যও হুমকির কারণ হচ্ছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে মিয়ানমারজুড়ে ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। বিপুলসংখ্যক মিয়ানমারবাসী এখন সংঘাতে আক্রান্ত। তারা প্রতি মুহূর্তে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সরকারি হুমকির সঙ্গে সেখানে বেসামরিক বাহিনীর হুমকিও জড়িত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছে না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমারের ২৭ লাখ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত।
সড়ক ও নৌপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে রাখাইনে খাদ্য সংকট এবং অন্যান্য সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। এটা সামগ্রিক পরিস্থিতির আংশিক চিত্র। নিঃসন্দেহে পরিস্থিতি খুব খারাপ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারে সেনা-অভ্যুত্থান হয়। এর পর থেকেই মিয়ানমারের জনগণ দুর্ভাগ্যে ভুগছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে তিন বছর ধরে পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছেই কেবল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের পর থেকে মিয়ানমারে চালের দাম বেড়েছে ২২০ শতাংশের বেশি। এর সঙ্গে বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্য এবং জ্বালানির ঘাটতি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যখন আমদানিকারকরা ডলারে অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি, যার ফলে প্রধান শহরগুলোতে জ্বালানি ট্যাঙ্কার থেকে তেল বের করতে দেরি হয়েছে, সে সময়ের পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে খারাপ ছিল। জ্বালানি ক্রয়ের জন্য সরকার আমদানিকারকদের তখন প্রয়োজনীয় মার্কিন ডলার সরবরাহ করতে পারেনি।
এমনিতেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ, তার ওপর চোরাচালানের কারণে আরও বেশি উদ্বেগজন হয়ে উঠছে। গত সপ্তাহের মতো সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো জানায়, বান্দরবান জেলার সঙ্গে বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্ত ভয়ের উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন এবং চিন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করছে। মিয়ানমারের মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়ছে। এটা এমনকি সীমান্তরক্ষী থেকে শুরু করে সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যেও আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে। সীমান্তের কাছের বাংলাদেশিরাও এখন ঘরবাড়ি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত জীবনযাপন করছে। কারণ, স্থানীয় প্রশাসন তাদের বাড়িঘর সরিয়ে নিরাপদে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দিয়েছে।
আমরা যদি পূর্বোক্ত তথ্য এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা সমস্ত ব্যাপারটাকে একবিন্দুতে এনে দেখি, তাহলে আমরা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করতে পারব, বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস চোরাচালান এখন একটি খুব সম্ভাব্য লাভজনক উদ্যোগ। এটা না বুঝতে পারলে ভবিষ্যৎ আরও খারাপ হবে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে তীব্র সংঘাতের জন্য বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা চোরাচালান বাড়তে দেখছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এখন প্রায় অকার্যকর। ফলে পশ্চিম রাখাইন, সিত্তওয়ে, বুথিডাং, রশিদং, রশিদং এবং মংডু এলাকায় প্রয়োজনীযয় দ্রব্যের ঘাটতির কারণে চোরাচালান পণ্যের আরও চাহিদা তৈরি হতে পারে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, অবৈধ উপায়ে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে সেই চাহিদা পূরণের জন্য চোরাকারবারির অভাব নেই।
সম্প্রতি, বাংলাদেশ নিজেই নানা কারণে আমদানির অভাবে ভুগছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম খাদ্য আমদানিকারক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ আমদানি করা শস্যের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার পতন এবং বাংলাদেশি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়েছে। এটা সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে, যেখানকার বাজার-অর্থনীতি অনেকটাই রাষ্ট্রীয় হিসাবের বাইরে। এটি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ককে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর সঙ্গে বেড়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্বেগ। কারণ, তারা এমনিতেই মূল্যস্ফীতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের বোঝায় জর্জরিত।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে