Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বাজারের দামে আগুন, ক্ষেপিয়ে তুলছে শ্রমিকদের

Rokonuzzaman Moni

রোকনুজ্জামান মনি

বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩

দেশের পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকের নূন্যতম বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে মজুরি বোর্ড। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) এ ঘোষণা দেন। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কার্যকর হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী। তবে মজুরি বোর্ডের এই সিদ্ধান্তকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, সর্বনিম্ন বেতন ২৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এ বাজারে সামান্য এই বেতনে জীবনধারণের ব্যয় মেটানো অসম্ভব বলে জানিয়েছেন তারা। তবে তাদের এ দাবিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছে তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
এদিকে, নিজেদের দাবি আদায়ে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ, মিছিল, সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন পোশাক শ্রমিকরা। আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে চারজন শ্রমিকের মৃত্যুতে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে শ্রমিক অসন্তোষ। এই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ব্যবহার করে কেউ কেউ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে এমন মন্তব্যকে শ্রমিকের দাবি না মানার পক্ষে অজুহাত হিসেবেই উল্লেখ করেছেন শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিই শ্রমিক অসন্তোষের মূল কারণ।
আশুলিয়ার বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ১৮ বছর ধরে কাজ করছেন বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিক উজ্জ্বল হোসেন। ১২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কোনো শ্রমিকই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে টিকে থাকতে পারবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। উজ্জ্বল বলেন, “বাজারে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বেড়েছে। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে এমন কোনো জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি। এ ছাড়াও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বাসা ভাড়া গত পাঁচ বছরে বেড়েছে কয়েকগুণ। এ অবস্থায় ন্যূনতম বেতন আট হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ করলেও এতে শ্রমিকের কোনো লাভ হবে না। এ টাকায় শ্রমিক তার পরিবারের জন্য দু' বেলার ডাল ভাত জোগাড়ও করতে পারবে না।”
২০১৮ সালে সর্বশেষ মজুরি বোর্ড যখন নূন্যতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে, তখন সে বেতনের অন্তর্ভুক্ত হন নারায়ণগঞ্জের আরেক পোশাক শ্রমিক সামিউল ইসলাম। আশুলিয়ার উজ্জ্বলের মতো একইরকম কথা বলেন সামিউল। তিনি বলেন, “বাসা ভাড়া দিতে হয় সাড়ে তিনি থেকে চার হাজার টাকা। সেই টাকা বাদ দিলে হাতে থাকবে আট হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে কিভাবে একজন শ্রমিক তার সংসারের খরচ মেটাবে আর কিভাবেই বা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবে! যারা সরকারি চাকরি করেন তারা কি একই পরিমাণ টাকা দিয়ে চলতে পারবেন! তারা যদি পারেন তাহলে আমরাও পারবো। তারা যদি না পারেন তাহলে আমরা কিভাবে পারি!”
চলতি বছরের জুলাইয়ের শুরুতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ অথবা চার হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। সামগ্রিকভাবে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪ শতাংশ। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে শীর্ষ ছয়টি খাতের মধ্যে শুধু তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে।
অন্যান্য খাতের তুলনায় এ খাতের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি থাকলেও খাত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের ভাগ্যের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান ও কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের জোট মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী তাসলিমা আক্তার। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে পোশাকশিল্প বেশ বিকশিত হয়েছে। তবে শ্রমিকদের জীবনমানের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। একজন শ্রমিকের প্রতিদিন ২২০০ ক্যালরির প্রয়োজন হয়। শ্রমিকরা তাদের এ চাহিদা পর্যন্ত পূরণ করতে পারছেন না। অনেক গবেষণা সংস্থা দেখিয়েছে, ঢাকা শহরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী চারজনের পরিবারে শুধু খাওয়া খরচ বাবদই মাসে প্রায় ২২ হাজার টাকা লাগে। এ ছাড়া অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ হাজার টাকা। তাহলে এতো কম বেতনে একজন শ্রমিক কিভাবে তার জীবনমান পরিবর্তন করতে পারবেন!”
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিই শ্রমিক অসন্তোষরের প্রধান কারণ উল্লেখ করে এই শ্রমিক নেত্রী আরও বলেন, “বাজারে প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। শ্রমিকরা যে বেতন পান তা দিয়ে কোনোভাবেই তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেন না। উচ্চ মূল্যস্ফীতিই শ্রমিক অসন্তোষের মূল কারণ। এ ছাড়াও ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ছিল প্রায় ১০০ ডলার। পাঁচ বছর তা বাড়িয়ে করা হলো ১১২ ডলার ৯৪ সেন্ট (সরকারি বিনিময় দর অনুযায়ী)। সেই হিসাবে বেতন বেড়েছে প্রায় ১৩ ডলার বা প্রায় ১৪০০ টাকা! এটা কতোটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন কিন্তু এড়ানোর সুযোগ নেই।”
শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পান বাংলাদেশের শ্রমিকরা। একই জায়গায় সবচেয়ে বেশি মজুরি চীনে। দেশটিতে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন ৩০৩ ডলার ৫৯ সেন্ট। ইন্দোনেশিয়ায় ন্যূনতম মজুরি ২৪২ ডলার ৯৪ সেন্ট। কম্বোডিয়ায় এর পরিমাণ ২০০ ডলার। আর প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ খাতে একজন শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ১৭১ ডলার ১৮ সেন্ট। তবে বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ৭২ ডলার ৪২ সেন্ট বলে চলতি বছরের অক্টোবরে ‘গার্মেন্টস খাতে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ: পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এ সংলাপে এ তথ্য প্রকাশ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
এদিকে, শ্রমিকদের ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি মেনে নিয়ে ২৫ হাজার টাকার দাবি থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছনে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজীম। তিনি বলেন, “শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা কম না। আলোচনার পরেই এ সিদ্ধান্ত এসেছে। সকল খরচ বাড়ায় শ্রমিকদের মতো মালিকরাও অনেক কষ্টের মধ্যে আছে। তবুও যৌক্তিক হারেই মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখানে খরচ কম থাকার কারণেই কিন্তু অর্ডার বেশি আসে। এখন খরচ যদি অত্যাধিক হারে বেড়ে যায় তাহলে বায়ার আসা কমে যাবে। এতে শিল্প নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সকলকে পরিস্থিতি বুঝে অযৌক্তিক দাবি থেকে সরে আসার আহ্বান জানাই আমরা।”
এ শিল্পকে ধ্বংস করতে অনেকেই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শ্রমিক বিক্ষোভ জাগিয়ে তুলছে উল্লেখ করে শহীদুল্লাহ আজীম বলেন, “আমাদের এ শিল্প নিয়ে অনেক চক্রান্ত চলে। অনেকেই এ শিল্পকে ধ্বংস করতে চায়। তারাই শ্রমিকদের বিক্ষুদ্ধ করে তুলছে। মনে রাখতে হবে আমাদের এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি ৪০ লাখ মানুষ জড়িত থাকলেও প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বিভিন্ন ভাবে এ খাতের ওপর ওতপ্রোতভাবে নির্ভরশীল। এমনকি আমাদের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বেশি অংশ আসে এ শিল্প থেকে। তাই যেকোনো চক্রান্তের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।”
তবে শ্রমিকদের ব্যবহার করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার বিষয়টিকে অনেকটা অজুহাত বলে মনে করছেন তাসলিমা আক্তার। তিনি বলেন, “শ্রমিকরা রাজ্য কিংবা সিংহাসন কোনটার জন্যই আন্দোলন করছে না। তারা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছেন। যারা বলছেন, শ্রমিকরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করছেন, তারা এটিকে একটা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। কারণ মজুরি বোর্ড গঠন করার পর ছয় মাস অতিক্রম হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার শেষ সময়ও শেষ হয়েছে ৯ অক্টোবর। কিন্তু তারা মজুরি প্রস্তাব নির্ধারণ করলো ৭ নভেম্বর। এতে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকরা ক্ষুদ্ধ হবেন। তবে নির্বাচনের আগে শ্রমিকদের আন্দোলনকে যে কেউ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারে, এই বিষয়টি আমরা সরকারকে অবগত করেছিলাম এবং বিষয়টি আগেই সুরাহা করার পরামর্শও দিয়েছিলাম। তারা সেটা করেননি। নির্বাচনের আগে যেহেতু সময় কম তাই তারা এখন তড়িঘড়ি করে একটা সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের চাপিয়ে দিচ্ছেন। যেমনটি তারা তাদের নেতাকর্মী দিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে হামলা চালিয়েছেন। তবে নতুন মজুরি ঘোষণা হলেও এখনো যেহেতু গেজেট আকারে পাস হয়নি, তাই আমরা বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করে যাবো।”
এ শিল্পকে যারা অস্থিতিশীল করছে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা নভেম্বরের মধ্যে ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে নেব। নভেম্বরের মধ্যে এটা হবে, ১ ডিসেম্বর এটা কার্যকর হবে। মালিকরাও মজুরি বৃদ্ধিতে রাজি হয়েছেন। জানুয়ারিতে শ্রমিকরা নতুন স্কেলে মজুরি পাবেন। তবে, শিল্পকে যারা অস্থিতিশীল করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। যারা ভাঙচুর করেছেন, ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগিয়েছেন, তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না৷’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ