Views Bangladesh Logo

সামাজিক উৎসবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে

বাঙালির জীবনে বিনোদনের সংস্কৃতি ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে আর এটি স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হতে শুরু করেছে। এক সময়ে ঈদ, পুজা, বাংলা নববর্ষ, বড় দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমার মতো সামাজিক উৎসবে দেশজুড়ে গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন খেলার আয়োজন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যাত্রা, নাটক, সার্কাস, কবিগান, বয়াতিদের মধ্যে গানের মাধ্যমে লড়াই ও গম্ভীরার আয়োজন হতো। শহর থেকে উৎসবের জন্য যোগসূত্র এবং নাড়ির টানে আবালবৃদ্ধবণিতা প্রিয়জনের সান্নিধ্য লাভ ও বিভিন্ন স্পর্শকাতরতায় গ্রামে ছুটে যেতেন। এরা এবং গ্রামে বসবাসরত মানুষ মিলে একসঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন। সেসব দিন, উৎসব-উদ্দীপনার ক্ষেত্রে এখন ভাটার টান।

ক্রমেই বদলে যাচ্ছে সেই আবেগময় উৎসব উদযাপনের প্রেক্ষাপট। মনমানসিকতায় অনেক পার্থক্য এবং পরিবর্তন। পাল্টে যাচ্ছে মূল্যবোধ এবং সৌজন্য। বাঙালির জীবনে সেই ঐতিহ্য কাতরতা কতটুকু কাজ করে বলা মুশকিল। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আগেকার দিনগুলোর সঙ্গে নতুন সহস্রাব্দে বাঙালির জীবনযাত্রায় অনেক পার্থক্য। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করার সময় কোথায়? সময়ের সঙ্গে ঢেউ খাওয়ার প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মানুষ নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। বেড়ে গেছে ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা। ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থ চরিতার্থ করার দৌড় চলছে। একটা সময় ছিল সামজিক উৎসবগুলোকে বিরাট জনগোষ্ঠীর আন্তরিকতা লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন ছিল।

এখন সেটি অনেক পেছনে হঠে গেছে। উৎসবগুলো হয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষের মতলব হাসিলের মোক্ষম সুযোগ। এরা সময়কে কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্নভাবে। বছর চারেক আগে লিখেছিলাম দুঃখ পাবার কারণ নেই, সময় যারা পড়তে পারে তারা জিতবে। এটাই জীবনের অলিখিত নিয়ম। আবেগ, উচ্ছ্বাস, আন্তরিকতা আমাদের বৃহত্তর সমাজে তো সব সময় হিসাবের পরাজয় খাতায় লিবিপদ্ধ। মানুষ গ্রামে যাচ্ছে অল্প সময়ের জন্য সব সময়, তবে সেই পরিবেশ কোথায়? অথচ আর্থ-সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামবাংলার অতীতের সেই স্বল্প সময়ে বিনোদনের সংস্কৃতি জগত এখন আরও অনেক বেশি চাঙ্গা এবং আনন্দঘন হওয়ার কথা।

বাঙালির জীবনে যৌথ পরিবার ক্রমেই বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সেই মূল্যবোধ, ভালোবাসা এবং সবাই মিলেমিশে সুখে-দুঃখে দিন কাটানোর দিনগুলো। হারিয়ে যাচ্ছে যৌথ পরিবার অবসরে পুরুষ ও মহিলাদের সেই লোভনীয় আড্ডা। বাঙালি কি পেরেছে তারা নিজস্ব সংস্কৃতির বাইরে বেরিয়ে এসে জিততে? বাঙালির জীবনে জাগরণের জন্ম হয়েছে। আর এই জাগরণের হাওয়া বইছে পরিবার ও সমাজ জীবনে। বাঙালি এখন পরিবর্তনের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে রাজি। শুভ পরিবর্তন তো সব সময় কাম্য। নিজকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। আত্ম-উপলব্ধি কতটুকু পারছে চারদিকে নিরানন্দ থেকে মুক্তি দিতে। বাঙালি অবশ্যই অন্যের থেকে নেবে তবে নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে নয়। বাঙালি কোথাও এগিয়েছে, কোথাও পিছিয়েছে এটাই সত্যি।

গ্রামবাংলায় বৃহৎ সামাজিক উৎসবগুলোকে ঘিরে বিনোদনধর্মী কর্মকাণ্ডে আগে যে রঙ্গ ছিল- সেই রঙ্গ তো ক্রমেই উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের নির্মল বিনোদন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো এখন আর আগের মতো অনুষ্ঠিত হয় না। সব ক্ষেত্রেই একটা সঙ্কুচিত ভাব। উৎসাহ এবং উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তবতায় যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়- এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। অথচ মানুষ কিন্তু আগের তুলনায় অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে গ্রামে ছুটে যান। সবাই চান অল্প সময়ের জন্য হলেও বৈচিত্র্যে ভরপুর জীবনের স্বাদ পেতে। কেউ কেউ বলেন- উৎসবের দিনগুলোতে বাড়তি বিনোদন সবাই মিলে উপভোগের যে একটি চমৎকার সুযোগ ছিল এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা সংস্কৃতির জীবনে ক্রীতদাসত্ব স্বীকার করে নেয়ার জন্যই হারাতে হচ্ছে। অনেকেই সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে ক্রীতদাসত্বকে বেজায় আনন্দে লুফে নিয়েছেন। এরা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন তারা পিছিয়ে নেই।

পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এরা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও এদের মন-মানসিকতার জয় সর্বত্র। এরা চান আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির ঝাণ্ডা উড়াতে। সমস্যা নেই। তবে নিজস্ব কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিকে অপাঙক্তেয় করে নয়। বাঙালি জাতিসত্তাকে অস্বীকার করা মানে নিজের পায়ে 'কুড়াল' মারা। একটি সময়ে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয় হতে বাধ্য ব্যাপকভাবে। মানুষ আগেও বিশেষ করে উৎসবকে ঘিরে গ্রামে যেতেন। এখন আরো বেশি যান। শহরের জীবন থেকে ছিটকে অল্প সময়ের জন্য হলেও গ্রামে ফিরে যাওয়ার হিড়িক আরো বাড়ছে। অধিকাংশ মানুষ কষ্ট স্বীকার করে হলেও হাসিমুখে গ্রামে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পৌঁছান। এই যে অগণিত মানুষ গ্রামে ছুটে যান- গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এটির অন্যরকম তাৎপর্য এবং গুরুত্ব আছে।

আমি যে প্রজন্মের প্রতিনিধি এ প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসে আসন গেড়েছেন। একটি সময়ে সামাজিক উৎসবগুলোর দিনগুলোতে (এখনো বিভিন্ন জেলার গ্রামীণ জনপদে অনুষ্ঠিত হয় আগের তুলনায় কম হলেও বিভিন্ন খেলাধুলার কর্মসূচি পালিত হয়) অগণিত গ্রামীণ জনপদে দুপুরে পুকুর, হাওর, খাল ও নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। অনুষ্ঠিত হতো নৌকাবাইচ। বিপুলসংখ্যক মানুষ নৌকাবাইচ দেখার জন্য ভিড় জমাতেন। প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো। সিনিয়র-জুনিয়র বহিরাগত এবং গ্রামে অবস্থানরত যুবকদের মধ্যে কোথাও কোথাও অনুষ্ঠিত হতো শহরের জামাই একাদশ বনাম গ্রামের শ্বশুরবাড়ি একাদশের মধ্যে আনন্দঘন ফুটবল ম্যাচ।

গ্রামে গ্রামে হা-ডু-ডু প্রতিযোগিতা (যেটি এখন কাবাডি খেলা হিসেবে পরিচিত) ছিল আরেক আকর্ষণ। ভলিবল প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হতো। দেশের কয়েকটি স্থানে ঘোড়ার দৌড় এবং ষাঁড় গরুর লড়াইও অনুষ্ঠিত হতো। লক্ষ্য একটাই ছিল নির্মল বিনোদন উপহার দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা। এ ছাড়া অনেক গ্রামীণ জনপদে সন্ধ্যার পর 'হ্যাজাক লাইটের' বাতির আলোতে অনুষ্ঠিত হতো স্থানীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মঞ্চস্থ হতো নাটক। আর এই নাটকে অংশ নিতেন শহর এবং গ্রামের কলা-কুশলীরা। কোথাও কোথাও অনুষ্ঠিত হতো যাত্রাপালা। গভীর রাত ধরে সেই যাত্রা দেখার ছিল আলাদা আনন্দ এবং উত্তেজনা। কোথাও কোথাও অনুষ্ঠিত হতো জারি এবং ফকিরী গানের মেলা।

আমি নিজে আমার কৈশোরে গ্রামে ঈদ উৎসব চলাকালে সার্কাস দেখেছি। দেখেছি কোরবানি দিনের সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ির বড় উঠানে জোসনা আলোতে বোন এবং ভাবিদের দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা খেলতে। দেখেছি বালিকা ও কিশোরীদের 'এপেনটি বাইসকোপ' খেলা খেলতে মহাআনন্দে। সময়ের পরিক্রমায় আমরা অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু এটি তো আমাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ। নিজেকে হারিয়ে নয়, নিজস্ব সংস্কৃতিরচর্চাকে ধরে রেখেই আমাদের সামনে এগোতে হবে।

ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ