Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

পাঁচ বছরে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রায় ৭ লাখ বিনিয়োগকারী

Rasel Mahmud

রাসেল মাহমুদ

সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

দেশের পুঁজিবাজারে চলছে ধারাবাহিক দরপতন। পুঁজি হারিয়ে দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। একই সঙ্গে ভুগছেন আস্থার সংকটে। ফলে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারী হারাচ্ছে বাজার। গত ৫ বছরে ‘আস্থার সংকটে’ পুঁজিবাজার ছেড়েছেন প্রায় ৭ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও হিসাবধারী। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা, রাতারাতি নীতি পরিবর্তন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে দেশের পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া সুদহার বৃদ্ধি ও আস্থার সংকটের কারণেও বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য যেসব বিও খোলা হয়েছিল প্রো-রাটা পদ্ধতি চালুর পর সেসব বিওধারী বাজার ছেড়েছেন।

তাদের মতে, এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও আস্থা পুনরুদ্ধার না হলে সংকট আরও দীর্ঘ হবে। এতে আরও বিনিয়োগকারী হারানোর শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

আইপিও-এর পূর্ণরূপ ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব। লিমিটেড কোম্পানিগুলো মূলধন সংগ্রহের জন্য প্রাইমারি মার্কেটে শেয়ার অফার করলে সর্বসাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সেই শেয়ার ক্রয়ের জন্য আবেদন করেন। এ প্রক্রিয়াই মূলত আইপিও।

আইপিওর ক্ষেত্রে এক সময় লটারি পদ্ধতি ছিল। এতে লটারির মাধ্যমে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হতো। ২০২১ সালে এই পদ্ধতি তুলে দিয়ে আনুপাতিকহারে শেয়ার বরাদ্দ দেয়ার পদ্ধতি চালু হয়। এই পদ্ধতি প্রো-রাটা বলে পরিচিত।

এই পদ্ধতিতে আইপিও আবেদনের আগে প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর বাজারমূল্যে ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে তথা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ থাকতে হবে। অর্থাৎ আইপিও আবেদন করার আগে একজন বিনিয়োগকারীর সেকেন্ডারি বাজারে ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ থাকতে হবে। আর অনাবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিনিয়োগ থাকতে হবে ১ লাখ টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি, এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পর পুঁজিবাজার থেকে অনেক বিও হিসাবধারী চলে গেছেন।

সিডিবিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবরে দেশি-বিদেশি (অনাবাসী) বিনিয়োগকারীসহ মোট বিও হিসাব ছিল ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫০টি। এর মধ্যে দেশি বিও হিসাব ছিল ২২ লাখ ১১ হাজার ২৫৭টি। আর অনাবাসী (নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি) বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৩টি। প্রায় ৪ বছর ১১ মাসের ব্যবধানে ২০২৪ সালের ২৩ নভেম্বর বিও কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ১২৮টিতে। এই সময়ে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমে হয়েছে ১৬ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৯টি।

অর্থাৎ দেশি বিও হিসাব কমেছে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৮টি। আর অনাবাসীদের বিও কমে হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৬১টি। অর্থাৎ তাদের বিও কমেছে ১ লাখ ১ হাজার ৭৩২টি।

ডিএসইর তথ্যমতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশিরা ৯ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছেন। একই সময়ে বিক্রি করেছেন ১৭ হাজার ৭১ কোটি টাকার শেয়ার। অর্থাৎ এ সময়ে তারা মুনাফা তুলেছেন ৭ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা।

বিপুল পরিমাণ মুনাফা করার পরও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে আস্থার সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়ার বড় কারণ আস্থার সংকট। সুদহার বাড়ায় দেশি বিনিয়োগকারীদের বড় অংশও বাজার ছেড়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, মোটা দাগে আস্থার সংকট এবং ইন্টারেস্ট রেট বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগকারীরা বাজার ছেড়ে চলে গেছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ফান্ড ক্রাইসিসও বিনিয়োগকারী হারানোর বড় কারণ। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও ফ্লোর প্রাইস আরোপের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

এদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপে আতঙ্কিত হয়ে দেশি বিনিয়োগকারীদের একাংশও শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এতে ২০২৩-২৪ সালের বেশির ভাগ সময় পুঁজিবাজারে দরপতন ঘটেছে। ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ৪ হাজার ২৯১ কোটি টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ ৫ বছরের মধ্যে করোনা মহামারির কারণে প্রথম দুই বছর পুরো বিশ্বের অর্থনীতিই স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে এই সময় বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। এতে বৈশ্বিক অর্থনীতি আরও টালমাটাল হয়ে ওঠে। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেটে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ৮৪ টাকার ডলার হঠাৎ বেড়ে ১৩০ টাকায় উঠে যায়। এই সুযোগে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিতে শুরু করেন। তাতে দেখা গেছে, গত ৫ বছরের প্রথম তিন বছরে, অর্থাৎ ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালেই শেয়ার বিক্রি করে ৭ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

এই পরিস্থিতির মধ্যে ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ব্যাংক খাতে লুটপাট ও পুঁজিবাজারে কারসাজির অভিযোগও জোরালো হতে শুরু করে। এতে বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সেই গুজবে আরও বাড়ে শেয়ার বিক্রির চাপ, ধস নামে বাজারে। দরপতন ঠেকাতে পুঁজিবাজারে আরোপ করা হয় ফ্লোর প্রাইস। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই সিদ্ধান্তে বিদেশিরা আরও দ্রুত শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়েছেন।

বিদেশি (অনাবাসী) বিনিয়োগকারী কমার বিষয়ে ব্র্যাক ইপিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসানুর রহমান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, গত আগস্ট মাসের পর থেকে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট পজিটিভ। এর আগে বিনিয়োগ কমার অনেক কারণ ছিল। তার মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা, এক্সচেঞ্জ রেট, ফ্লোর প্রাইস আরোপ অন্যতম কারণ। অনাবাসী বিনিয়োগকারীরা এক সময় আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) শেয়ার কেনার জন্য অনেক বিও মেইনটেইন করতেন। যখন থেকে আইপিওতে আবেদনের জন্য ৫০ হাজার টাকা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়, তখন থেকে এই হিসাবগুলো কমতে শুরু করেছে।

বিআরবি সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আলমগীর হোসেন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, আইপিও শিকারি বিও হিসাবগুলো নতুন নিয়মের কারণে এক সময় নিষ্ক্রীয় হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে তারা পুঁজিবাজার ছেড়ে গেছে।

বিও হিসাব কমার কারণ হিসেবে প্রায় একই কথা বলেছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম। ভিউজ বাংলাদেশকে তিনি বলেন, এক সময় বিও হিসাব থাকলেই আইপিওতে আবেদন করা যেত। প্রো-রাটা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই বিও হিসাব কমছে।

তবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিদেশিরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আসতে শুরু করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফের পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ