সোনাদিয়ায় বেজার লিজ স্থগিত, ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেলো দ্বীপটি
কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) দেয়া লিজ স্থগিত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করছেন দ্বীপটির বাসিন্দা এবং পরিবেশকর্মীরা। এ সিদ্ধান্তে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের একমাত্র লোনাজলের প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ বন এবং সামুদ্রিক কাছিমের নিরাপদ প্রজননক্ষেত্রটির সবুজ বেষ্টনী ও জীববৈচিত্র্যসহ ইকোসিস্টেম ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে বলেও মনে করছেন তারা।
ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার শর্তে ২০১৭ সালে পুরো দ্বীপটির প্রায় নয় হাজার ৪৬৭ একর জমি মাত্র এক হাজার এক টাকা সেলামিতে বেজাকে বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার, যা মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) স্থগিত করা হয়েছে।
সোনাদিয়ার অবস্থান কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে। মহেশখালীর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে কয়েকশত পরিবারের প্রায় তিন হাজার মানুষের বসবাস। মূলত সাগরে মাছধরা ও শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতে জীবিকা নির্বাহ করেন অধিকাংশ বাসিন্দা।
এ অঞ্চলে রয়েছে কেওড়া, কেয়া, সাদা বাইন, কালো বাইন, হরগোজা, নোনিয়াসহ প্রায় ত্রিশ প্রজাতির উদ্ভিদ। দ্বীপ ও সংলগ্ন বনভূমিতে পাওয়া যায় ১৯ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক, বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া, কাছিমসহ প্রায় ৮০ প্রজাতির সাদা মাছ। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোরাল, বোল, বাটা, তাইল্লা, দাতিনা, কাউন ছাড়াও অন্য জাতের প্রচুর মাছেরও দেখা মেলে।
সরকারের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ২০১৯ সালের সমীক্ষায় জানিয়েছিল, সোনাদিয়া দ্বীপে রয়েছে চামচঠুঁটো বাটনসহ বিশ্বজুড়ে মহাবিপন্ন তিন প্রজাতির পাখি।
সেভ দ্য নেচারের চেয়ারম্যান পরিবেশকর্মী মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে সোনাদিয়া দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন হাঁসের চর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে সামুদ্রিক সবুজ কাছিমসহ তিন প্রজাতির কাছিম বছরে ২০ হাজারেরও বেশি ডিম পাড়ে, যা বঙ্গোপসাগরে জেলিফিশসহ মাছের ডিম পোনা ধ্বংসকারী ক্ষতিকর প্রাণিদের প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করে মৎস্য উৎপাদনকে স্বাভাবিক রাখে। দ্বীপের আশপাশে দেখা মেলে ইরাবতী, ইন্দো প্যাসিফিক ও পাখনা ছাড়া ডলফিনেরও।
বেজাকে দেয়া লিজে বঞ্চিত সোনাদিয়ার মানুষ
বেজাকে লিজ দেয়ার পরেই উপকূলীয় বন বিভাগ সৃজিত উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর প্রায় ৭০ শতাংশ ঝাউ, কেওড়া, সাদা ও কালা বাইন, হরগোজাসহ নানা প্রজাতির গাছ কেটে লুটপাট চালায় কয়েকটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। জমির শ্রেণি পরিবর্তনের পর স্কাভেটর দিয়ে মাটি কেটে নিশ্চিহ্ন করে চিংড়িঘের তৈরি করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার একর জমিতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আরও দুই হাজার একর ভূমিতে চিংড়ি উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে।
২০১৭ সালে পুরো দ্বীপটি বেজা অধিগ্রহণ করায় ভেঙে পড়ে স্বাস্থ্যসেবা। শিক্ষাক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়েছে দ্বীপটির শত শত শিশু এবং কিশোর-কিশোরী। একটিমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব বেশি হওয়া এবং প্রায় সময়ই স্কুলটিতে শিক্ষক না থাকায় শিক্ষাবঞ্চিত তারা।
পশ্চিম সোনাদিয়ার বাসিন্দা শুক্কু বিবি জানান, চোখের সামনেই বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তার মেয়ে। ‘সন্তান জন্ম দেয়া যেনো এই দ্বীপে অপরাধ। না হলে কেন চিকিৎসাহীন অবস্থায় ওপারে চলে যেতে হবে মেয়েটিকে’- আক্ষেপ তার।
গ্রাম্য চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান এবং এসএমসির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাজু বেগম। কোনো ডাক্তার না থাকায় শেষ আশ্রয় তিনি। তাকেই ডাক্তার বলে বিশ্বাস করেন দ্বীপের মানুষ। সাজু বেগম খাবার স্যালাইন, প্যারাসিটামল এবং ব্যথার ওষুধ দিয়ে থাকেন তার কাছে আসা অসুস্থদের।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিকি মারমা জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনে অনেকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সোনাদিয়া দ্বীপ বেজার অধিগ্রহণে থাকায় সেটি বাস্তবায়ন করা যায়নি।
সাড়ে সাত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে কিশোর জয়নাল। সে জানায়, দ্বীপে আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় আর পড়াশোনা হয়নি।
সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক শিক্ষক আব্দুল গফুর জানান, দ্বীপের দুর্গম পথ এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় স্কুলে স্থায়ীভাবে থাকেন না কোনো শিক্ষক। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে আসা শিশুদের কথা চিন্তা করে বিনা বেতনে পাঠদান করেন তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিকি মারমা জানান, বিদ্যালয়টিকে টিকিয়ে রাখতে খুব চেষ্টা করছেন তারা।
আইন লঙ্ঘন করেই লিজ
‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫’ অনুসারে ২০০৬ সালে দ্বীপটিকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা দেয় সরকার। নিষিদ্ধ করে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, এমন কর্মকাণ্ডও।
এ আইন লঙ্ঘন এবং পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই সোনাদিয়ার জমি বেজাকে লিজ দেয়া তৎকালীন সরকারের ভুল পরিকল্পনা ছিল বলে মনে করেন পরিবেশকর্মী মোয়াজ্জেম হোসেন।
ভিউজ বাংলাদেশকে তিনি বলেন, মনগড়া তথ্য দিয়ে প্রকৃতি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার স্বার্থ উপেক্ষা করে পর্যটনশিল্প বিকাশের নামে প্রকৃতি হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা হয়েছে, যা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা উচিত। ইকোট্যুরিজম গড়তে বেজাকে সরকার এই এলাকা বরাদ্দ দিয়েছিলো। অথচ অধিগ্রহণের পর সংস্থাটির ইন্ধনেই আরো বেশি প্যারাবন নিধন হয়েছে বলেও অভিযোগ তার।
‘প্রাকৃতিক ভারসাম্য সুরক্ষিত ছিল বলেই গত দুইশ’ বছরে মহেশখালী দ্বীপের আয়তন চারশ’গুণ এবং সোনাদিয়া দ্বীপ শতগুণ বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃতির সাথে সহিংস আচরণ করলে সেন্টমার্টিনের মতোই সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হবে অচিরেই’- বলেন তিনি।
ভারতের মাহিন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারিংকে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ দেয় বেজা। সেটি দেখলে যে কেউ প্রত্যাখ্যান করবেন বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
সোনাদিয়ার দায়িত্ব দিতে হবে দ্বীপবাসীকেই
সেন্টমার্টিনের ইকোসিস্টেম একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে দ্বীপটির জীববৈচিত্র্যের নিরাপদ প্রজনন সুরক্ষায় এতোদিন পর কঠোর হয়েছে সরকার। একইভাবে সোনাদিয়া দ্বীপের ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারকে প্রয়োজনীয় এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে সোনাদিয়াও সেন্টমার্টিনের মতো সংকটে পড়বে বলে মনে করেন সেভ দ্য নেচার প্রধান মোয়াজ্জেম হোসেন।
তিনি বলেন, পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সব এলাকায়ই উন্নয়ন ও ইকোট্যুরিজম পার্কের নামে ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। ইকোসিস্টেম ফিরিয়ে আনতে সোনাদিয়া দ্বীপে চিংড়িঘেরসহ সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ফের পরিকল্পিত প্যারাবনের সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে।
লিজ সম্পূর্ণ বাতিল করে উপকূলীয় বন বিভাগের কাছে সোনাদিয়া দ্বীপ হস্তান্তরসহ সমগ্র মহেশখালীর ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান তিনি।
বেজা বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে নয়, মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দাদেরই দ্বীপ রক্ষা ও উন্নয়নের ভার দেয়া উচিত বলেও মনে করেন এই পরিবেশকর্মী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে