কবি সৌমিত্র দেব: সমকালের স্পষ্টভাষী-প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের অকালপ্রয়াণ
লেখালেখি, বক্তৃতা, আলোচনা সভা, মানববন্ধন, তর্ক-আড্ডায় বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পক্ষে আজীবনের লড়াকু ছিলেন সদ্যপ্রয়াত কবি সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র দেব। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংটকে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ সোচ্চার। প্রগতির পক্ষে ছিলেন অগ্রগামী।
মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শোকের ছায়া নেমে আসে। কারণ এদিন সকালে খিলগাঁওয়ের একটি হাসপাতালে মারা যান কবি। বিশেষ করে কবির শুভাকাঙ্ক্ষী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা কবির মৃত্যু নিয়ে শোক প্রকাশ করেন। কবির বন্ধুরা এ মৃত্যুকে ‘আকস্মিক’ ও ‘অবিশ্বাস্য’ বলে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন তারা। অনেকে লিখেছেন-‘সমকালের স্পষ্টভাষী-প্রতিবাদী।’
কবি সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, কবি সৌমিত্র দেব ২৭ জুলাই, ১৯৭০ মৌলভীবাজার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সুশীতল দেব ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। মা মায়া দেব। সৌমিত্র দেব মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, মৌলভীবাজার সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে করেছেন সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। এ ছাড়া তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিকল্পনা, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং নিয়েছেন। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে চতুর্থ ব্যাচে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২০০৫ সালে তিনি ১০ম উত্তর আমেরিকান বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে অংশ নেন। এ ছাড়া চীন, মালয়েশিয়া, নেপাল ও ভারতে আরও বেশ কিছু অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে উজ্জ্বল করেছেন দেশের ভাবমূর্তি।
কবি হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। তার দুই ডজনের চেয়েও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনি লিখতেন তিনি। তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মধ্যে আছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ও বিকল্প গণমাধ্যম’, ‘অজবীথি’, ‘বন পর্যটক’, ‘নীল কৃষ্ণচূড়া’, ‘পূর্ব থেকে পশ্চিমে’, ‘জলে স্থলে অন্তরীক্ষে’, ‘হিমালয় কন্যার হাসি’, ‘তুমুল তুষার বৃষ্টি’, ‘আগুন পিপাস’, ‘পাথরের চোখ’ প্রভৃতি।
সৌমিত্র দেব কবিতা লিখছেন কিশোর বয়স থেকে। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই বেছে নিয়েছেন। সাংবাদিকতা শুরু দৈনিক প্রথম আলোতে। পরবর্তীকালে টানা ৫ বছর কাজ করেছেন দৈনিক মানবজমিনে। ছিলেন সহকারী সম্পাদক। সর্বশেষ তিনি অনলাইন গণমাধ্যম রেডটাইমস ডটকম ডটবিডির প্রধান সম্পাদক ছিলেন। সৌমিত্র দেব পেয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা ২০১৮।
কবি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে সৌমিত্র সেই কবি, যিনি বিশটি বছর পর আলোর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার কথা বলেন, অগ্নিকে গিলে ফেলেন, ব্রহ্মাণ্ডটা তুলে নেন হাতে অথবা শহরকে বিয়ে দেন পাশের বাড়ির গ্রামের সঙ্গে। যার কবিতায় জ্যোৎস্না আর অন্ধকার ক্রসফায়ার করে, যে কবি ক্ষিদে দিয়ে তৈরি করেন ফুল এবং অতিকায় অজবীথি ঘিরে নগর কাকের বাসা দেখেন। ফিরিয়ে আনতে চান কোলাহল ভরা অন্ধকার দিন।
কবির বন্ধুরা বলে থাকেন সৌমিত্র দেবের কবিতার সবচাইতে সমৃদ্ধ দিক তার কবিতায় ছন্দ, রূপক, শৈল্পিক সুররিয়ালিজমের নিখুঁত ব্যবহার, যা অপরিহার্য জেনেও আজকাল অনেক কবি পরিহার করেন, অথবা সেটা জানার প্রয়োজন বোধ করেন না।
কবির শুভাকাঙ্ক্ষী কুমার প্রীতীশ বলেন, ‘এভাবে চলে যাওয়ার কথা ছিল না সৌমিত্রদা। ক্ষতি হয়ে গেল অনেক। আপনি কবিতা লিখতেন। আমাদের সমকালের স্পষ্টভাষী-প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন।’
কবির বন্ধু উৎস প্রকাশনীর কর্ণধার মোস্তফা সেলিম বলেন, ‘বন্ধুর অকাল প্রয়াণে ব্যথাতুর হয়ে পড়েছি। তার প্রতি রইল শ্রদ্ধা।’
কবির স্ত্রী ডিমপল দেব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসুকে কবির বিদায়ের ছবি শেয়ার করে লিখেছেন- ‘আমার সব রং নিয়ে সৌমিত্র চলে গেল।’
সর্বশেষ ‘ক্রিয়েটিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন আয়োজিত জাতীয় জাদুঘরের সামনে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা অবনতির প্রতিবাদে মৌন মানববন্ধনে তিনি জ্বালাময় বক্তব্য রাখেন।
আমার স্থুল এ রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, নায়ক-গায়কের মৃত্যুতে রাষ্ট্র যেভাবে শোকাহত হয় কবির মৃত্যুতে সেভাবে শোকাহত হন না। রাষ্ট্রের কাছে কবি ঠুনকো বিষয়। কোন কবি মারা গেল, কোন কবি গভীর অসুস্থ হলো সেদিকে তেমন একটি যথাযথ খেয়াল রাখে না আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা।
কবি সৌমিত্রের নিথর দেহ তার জন্মশহর মৌলভীবাজার নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানেই তার সৎকার শেষে সমাধিস্থ করা হবে। আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী, কবির বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে