Views Bangladesh Logo

সত্য বললে আর নির্বাচন চাইলে বলে ভারতের দালাল

Fazlur  Rahman

ফজলুর রহমানএর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার

রাজনীতির চারণকবিখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান। সাবেক সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ-৩। কিশোরগঞ্জ জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি। দেশ, মাতা, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় যে কোনো সংকট-দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে তিনি আবির্ভূত হন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে। সর্বোচ্চ সোচ্চার থাকেন ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আপসহীন এ ব্যক্তিত্ব কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের করনসি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। সম্প্রতি ভিউজ বাংলাদেশের মুখোমুখি হন বরেণ্য এ রাজনীতিবিদ। কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী বাংলাদেশ, রাজনীতি, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানসহ সমসাময়িক বিষয়ে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের অ্যাডিটরিয়াল অ্যাসিসটেন্ট শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।

ভিউজ বাংলাদেশ: জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা না চেয়ে বরং মুক্তিযুদ্ধকে জাস্টিফাই করে যাচ্ছে এখনো, আপনার ব্যাখ্যা কী?

ফজলুর রহমান: জামায়াতে ইসলামী দুইটা জায়গাতে ভুল করেছে। ১৯৪৭ সালে যখন সব মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলন করলো জামায়াতে ইসলামী তখন বিরোধী ছিল, তাদের নেতা ছিলেন আবুল আলা মওদুদী। জামায়াত ওখানে মস্ত বড় ভুল করেছে পরে ক্ষমা চেয়েছে। মওদুদীর ফাঁসির অর্ডারও হয়েছিল, সেটাও সে ক্ষমা চেয়ে বেঁচেছে। জামায়াতের পাকিস্তানের রাজনীতিও ভুল ছিল। ২৩ বছরে স্বাধীনতার সংগ্রামেও জামায়াত ছিল না। একাত্তরেও বিরোধী ছিল জামায়াত। কাজেই জামায়াত বারেবারেই ভুল করেছে। একাত্তরের যারা জামায়াতের নেতা ছিলেন তাদের দু-একজন হয়তো এখনো বেঁচে আছেন, না হয় নাই বললেই চলে; কিন্তু দল হিসেবে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধে অপরাধ করছে। মুক্তিযুদ্ধে ভুল করছে। মুক্তিযুদ্ধে তারা আল বদর সৃষ্টি করে বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে। কাজেই জামায়াত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কি বিশ্লেষণ করল কি করল না- এটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নাই। বরং আমার হাসি পায়।

কারণ, এখন যদি আবু জাহেল আবু লাহাবের সন্তানরা ইসলাম নিয়ে বিতর্ক করে এটা যেমন ইসলামের পক্ষে আসবে না, ঠিক তেমনি জামায়াত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কি বললো না বললো এতে কিছু আসে যায় না। ‘তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবিও ওতাব্ব/ মা আগনা আনহু মালুহু ওমা কাসাব।’ আবু জাহেল আবু লাহাবের বংশধরদের যদি দেয়া হয় যে তোমরা এর বিশ্লষণ কর বা ইসলাম কী জিনিস বিশ্লেষণ কর। তারা এখনো বলবে- আরে, মোহাম্মদ (সা.) তো ভুল ছিল। কাজেই জামায়াত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কি বিশ্লেষণ করলো- এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই। তবে জামায়াতের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে এবং আমিও মনে করেছিলাম এরা বোধ হয় সংশোধন হবে। নতুন রাজনীতি শুরু করবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তী সরকারে ওপর জামায়াতের ভূত চেপেছে বলে মনে হয় আপনার?

ফজলুর রহমান: এ সরকারের ওপর টোটাল প্রভাবটাই জামায়াতের। ভূত আমি বলব না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যারা এখন শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বলতেছে, ইসলামী ছাত্রশিবির ৫ আগস্ট বিপ্লবের ভ্যানগার্ড। তারা এখন ডাক দিয়ে বলুক তো দেখি- যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ মানি না, মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া, ’৭২-এর সংবিধান কবর দিয়ে দিব। যারা মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিল, নেতারা সব অপাঙক্তেয়। তখন দেখা যেত তাদের ডাকে কে সাড়া দিত।

এখন দেখুন জিয়াউর রহমানকেও ধরেছে। বিএনপি অনেক পরে বুঝেছে। আমি প্রথম দিন বলেছি, যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বকা দিয়েছে দুদিন পরই জিয়াউর রহমানকেও বকা দিবে। দিয়েছে কি না আপনারা দেখুন। কারণ মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিব একা করছে বললে হবে না। শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধে ছিলই না। শেখ মুজিব ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো ২৬ মার্চ থেকে। কেন? স্বাধীনতা সংগ্রামটা ছিল জমিটা আমার কিন্তু অন্যরা দখল করে রাখছে। আর মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই আমার জমি যেটা সিএস/আরএস, এটাকে মুক্ত করার জন্য আমি অস্ত্র ধরেছি। সেই আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতার নাম হলো সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ তথা মুজিবনগর সরকার। সামরিক নেতার নাম হলো জেনারেল ওসমানি, জিয়াউর রহমান, সিআর দত্ত, আবুল বাশার, কর্নেল তাহের, কাজী নুরুজ্জামান, মেজর জেনারেল মঞ্জুর, মেজর জলিল, খালেদ মোশারফ, জেনারেল শফিউল্লাহ- এরা হলো মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রধারী নেতা। যেমন ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধের সময় ভারতের রাজনৈতিক নেতা; কিন্তু জেনারেল মানিক শাহ প্রধান সেনাপতি। কাজেই কাউকে বাদ দিয়ে কেউ যুদ্ধ করেনাই। সুতরাং শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন গালি দিবে বুঝতে হবে একটু পরেই জিয়াউর রহমানকেও সে গালি দিবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা চাননি, তিনি পাকিস্তানি আর্মির হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন- এমন কথা শোনা যাচ্ছে, আপনার ব্যাখ্যা কী?

ফজলুর রহমান: শেখ মুজিবকে নিয়ে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করতে দেন। যত বিশ্লেষণই করুক, যে যাই করুক ইতিহাসে বাঙালি জাতির মধ্যে শেখ মুজিবের নামটা ফাইনাল খেলায় ক্যাপ্টেন হিসেবে ১ নম্বরে থাকবে। কেউ ফিরাতে পারবে না। আর জিয়াউর রহমানের নামটা থাকবে মেজর জিয়া- ‘আই ডু হিয়ার বাই ডিকলারড দ্য ইনডিপেন্ডেনস অব বাংলাদেশ।’ প্রথমে বলছে নিজের নাম পরে বলছে অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেড লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজেই তিনিও একটা সেঞ্চুরি মেরেছেন। জেনারেল ওসমানি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। দেখলাম, জামায়াতের আমির বলছে, মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল ওসমানি সর্বাধিনায়ক। (আমিরের বাড়ি সিলেট ওসমানি সাহেবের বাড়িও সিলেট, কাজেই উনি বোধ হয় একটু পক্ষপাতিত্ব করেছে!) আসলে জেনারেল ওসমানি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন না। সর্বাধিনায়ক হয় সেই, যিনি প্রেসিডেন্ট। একটা হলো কমান্ডার ইন চিফ তিনি জেনারেল ওসমানি। সর্বাধিনায়ক হলো সুপ্রিম কমান্ডার, তিনি হলেন প্রেসিডেন্ট। এখন এটা বললে বলবে ফজলুর রহমান তো খালি শেখ মুজিবের কথা বলে। আবারও বলছি, সুপ্রিম কমান্ডার হয় একটা দেশের প্রেসিডেন্ট, তিনিই হলেন সর্বাধিনায়ক। আর প্রধান সেনাপতি সিএনসি (কমান্ডার ইন চিফ), তিনি ওসমানি।

জামায়াতের আমির তারা ডিকশনারির বাইরে খুব একটা কথা বলে না। তিনিও ডিকশনারির বাইরে কথা বললেন যে ওসমানি নাকি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। অথচ না, ওসমানি সাহেব মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। জিয়াউর রহমান ব্রিগট কমান্ডার জেড ফোর্স, খালেদ মোশাররফ ব্রিগেড কমান্ডার কে ফোর্স, শফিউল্লাহ ব্রিগেড কমান্ডার এস ফোর্স- এগুলো জানতে হবে বুঝতে হবে। আজকে যেসব ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলে এদের বাপেদেরও জন্ম হয়নাই। বাপেদের জন্ম হলেও বাপের সঙ্গে মায়ের দেখা হয়নাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যেসব ছেলেরা এখন উপদেষ্টা পরিষদে বসে আছে, বড় বড় কথা বলে ওদের বাপই আমার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট। কাজেই এরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যখন কথা বলে আমার হাসি পায়। খুব হাসি পায়, রাগও লাগে; কিন্তু সন্তানের প্রতি তো আমি রাগ করতে পারি না। এদেরকে কারা এ শিক্ষা দিছে আল্লাহ জানে। আল্লাহ এদেরকে হেদায়েত দান করুক।

আমার কথা সোজা- বাংলাদেশে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধ মেনেই থাকতে হবে। কথাটা খুব ঠিক। কারণ মুক্তিযুদ্ধে বাদ দিলে তো বাংলাদেশ থাকে না। মুক্তিযুদ্ধ হলো বাংলাদেশের মায়ের নাম। মুক্তিযুদ্ধের পেট চিরে এই বাংলাদেশ বের হয়েছে। এর পরে বাংলাদেশ। না হলে তো এটা পূর্ব পাকিস্তান। কাজেই মাকে যারা অস্বীকার করে, তারা সুসন্তান না।

ভিউজ বাংলাদেশ: স্বাধীনতার পর সিরাজুল আলম খানের কারেক্টারকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ফজলুর রহমান: সিরাজুল আলম খান ১৯৬২ সাল থেকে ছাত্রদের নিয়ে ধীরে ধীরে আন্দোলন শুরু করছে- ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘পাকিস্তান চাও না বাঙালি জাতি রাষ্ট্র চাও’- এই যে বাঙালির জাতি রাষ্ট্র এখন আর জাতিরাষ্ট্র বলে না কেউ। আমরাও বলতে চাই না কারণ এটা সবার রাষ্ট্র। ঊনসত্তর-একাত্তর-সত্তর সালে আমার আঙুলের রক্ত কেটে সিরাজুল আলম খানের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছি। আট হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল বিএলএফ (বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স) পরে যেটা মুজিব বাহিনী বলা হয়। সিরাজুল আলম খান এটার এক নাম্বার উদ্যোক্তা। আমি শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক সাহেব, তোফায়েল আহমেদকে ছোট করতে চাই না; কিন্তু সিরাজুল আলম খান এটার ফিলোসোফার গাইড। অনেকগুলো স্লোগান তার।

জাতীয় পতাকাটা কীভাবে হলো, শুনুন। আমি ছিলাম ইকবাল হলের ১১৬ নাম্বার রুমে। সিরাজুল আলম খান ডাক দিলো, কিরে কুমিল্লার শিবনারায়ন দাশ। পারবে না পতাকা বানাতে? দাদা, আপনি হুকুম দিলে আমি পারব শিবনারায়ন বলছেন। শিব নারায়ণ দাশ সারারাত ধরে বাংলাদেশের পতাকা আঁকলেন; কিন্তু দেখেন, এই লোকটা শেখ হাসিনার আমলে মারা গেল এত অকৃতজ্ঞ মূর্খ আওয়ামী লীগাররা শিব নারায়ণ দাশের জন্য একটা শোকসভাও করে নাই। সিরাজুল আলম খানের জন্য একটা শোকবার্তাও দেয় নাই। এরা এত অকৃতজ্ঞ। এ কারণে এদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। ভাগতে হয়েছে।

আমি সেই ফজলুর রহমান যে মুক্তিযুদ্ধের সব দেখছি। মুক্তিযুদ্ধের গান কীভাবে হয়েছে শুনুন। অজয় রায় ও জাহিদুর রহিম দুজন ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। জাহিদুর রহিমের কণ্ঠই ছিল সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। তিনি ১৯৭৯ সালে মারা গেছেন। সিরাজুল আলম খান বললেন, আজকে আপনার কণ্ঠে আমি ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা শুনব। এই ফজলুর রহমান হতভাগারা উপস্থিত সেখানে। কারণ আমি ইকবাল হলের ছাত্র। ময়মনসিংহের ডিসি খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হলেন তিনিও। ১৯৬৯ সালে ছাড়া পেয়ে মিটিং করতে আসলো হলে। ওইদিন জাহিদুর রহিম গানটা গাইলো-‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি/চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় ভাসি।’ এখান থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে ভারতের দেরাদুনে ভোর পাঁচটার সময় পূর্ব দিকে সূর্য উঠতেছে আর আমি আমি ফজলুর রহমান গান গাইতেছি। আমার পেছনে শত শত ফোর্স ট্রেনিং দিচ্ছে, কারও বুক ভেসে যাচ্ছে পানিতে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় দুবার বুক ভাসছে। পতাকা তুলেছি এবং নামিয়েছি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

যুদ্ধে গিয়েছি। সাথী পড়ে গেছে। গুলি খেয়েছে। তার মধ্যে লাফ মেরে উপরে উঠেছে। আমাকে বলেছে, মামা, মাকে দেখো, আর তো কেউ রইলো না। মায়ের একমাত্র সন্তান পাগল হয়ে মরছে। বৈষম্যবিরোধীরা বলেছে ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান নাকি মুক্তিযুদ্ধ। কার সঙ্গে কি তুলনা করে? গাঙ সাঁতরাইয়া পার হইছো, পাক বাহিনীর গুলি খাইছি? পাকবাহিনী গুলি করে একদিনে ১৫ হাজার লোক মারছে বুড়িগঙ্গাতে। বুড়িগঙ্গা লাল হয়ে গেছে। ১০ হাজার লোক মারছে জিঞ্জিরাতে। একদিনে ২৫ হাজার লোক মারা গেছে শুধু কেরানীগঞ্জে। ২ মে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একদিনে রক্তাক্ত হয়ে গেছে সব। কি কয় না কয়, অত সোজা?

মোস্তফা মহসীন মিন্টুর মতো মুক্তিযোদ্ধারা এখনো জীবিত আছে, জিজ্ঞাসা করেন। জিঞ্জিরা-কেরানীগঞ্জে একটা বাড়িঘরও ছিল না সব পুড়ে ফেলেছে পাকবাহিনী। সেই মুক্তিযুদ্ধ নদী সাঁতরিয়ে রাইফলেটা নিয়ে পার হয়েছে। শত শত মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনী গুলি করেছে বাঙ্কারে ক্রলিং করে যাইতেছে। কর্নেল তাহেরের পা গেছে। শত শত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়ে গিয়েছে, তারপর পাকবাহিনী পালাইছে। এত সোজা? কি কয় এসব কথা।

হে বাঙালি, কিছুই বুঝবেন না, কিছুই জানবেন না? এ দেশের ভাত খান, এ দেশের কাপড় পরেন। এ দেশে আপনার সন্তানের জীবন চলে, মুক্তিযুদ্ধটা ভুলে যাবেন? মুক্তিযুদ্ধ ভুলে যাবেন? (ইমোশনাল, আই এম সরি)।

আমি চ্যালেঞ্জ করলাম আমার এলাকা ইটনা থানার একটা গ্রাম ৩৬, চারশো মানুষ একসঙ্গে নৌকা দিয়ে ইন্ডিয়া যাইতেছিল। ইটনা থানার সামনে দিয়ে আসার পরে সমস্ত স্পিডবোট দিয়ে রাজাকার আর পাকবাহিনী ধরে চারশ লোককে মেরেছে এবং চারশ লোককে তিন ঘণ্টার মধ্যে গুলি করে পানিতে ফেলে দিয়েছে শ্রাবণের বর্ষায়। চারশ লোক একটা গ্রামের, একটা লোক জীবিত ছিল না। সেই গ্রামে ৪২৬ জন লোক একসঙ্গে মারা গেছে একদিনে।

কাজেই মুক্তিযুদ্ধ কী যারা না দেখছে, তারা কখনোই বুঝবে না। যখন কেউ রংঢং করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলে আমি সবাইকে হেসে হেসে উড়িয়ে দিই; কিন্তু মনে এত কষ্ট হয় যে আল্লাহ আমারে কেন বাঁচিয়ে রেখেছে? তুমি আমার মৃত্যু দাওনা কেন? এগুলো তো আমার শোনার কথা না। শেখ মুজিবকে নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, নেতাদের নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, শাসন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন থাকবে কেন?

ভিউজ বাংলাদেশ: ২০২৪ এর আন্দোলনে আমরা দেখলাম ছাত্র-ছাত্রীরা টিএসসি, শাহবাগ, রোকেয়া হলে রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত গেয়েছেন, আগুনের পরশমণি গেয়েছেন। অভ্যুত্থান শেষে দেখা গেল একটা পক্ষ ইসলামিক বিপ্লব বলছে-আপনার ব্যাখ্যা কী?

ফজলুর রহমান: মুনাফেকি। আমিও শুনেছি, ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিবরে। ‘আমিও শুনেছি নজরুলের ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’ আমিও শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পথে মানুষকে ডাকছে; কিন্তু এরা হলো ছদ্মবেশধারী মুনাফেক। আজকে যা করছে। একটা দিন কিন্তু প্রশ্ন আসবে যে হাসিনা ফ্যাসিস্ট ছিল, খুব খারাপ ছিল। তো ফ্যাসিস্টের চেয়ে মুনাফেক খুব ভালো কি না? ইসলাম কি বলে? মৌলানা সাহেবরা যে প্রত্যেকদিন লাখে লাখে বক্তৃতা করেন তাদের আমি জিজ্ঞাসা করি- কে বেশি খারাপ? ফ্যাসিস্ট না মুনাফেক? ইসলামের দৃষ্টিতে এটার ব্যাখ্যা দিলে আমার মনটা শান্তি হবে। মুনাফেকি চলছে। সেদিন যদি বলতো- আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ মানি না, এটাকে আমরা ছুড়ে ফেলে দিব, ’৭২-এর সংবিধানকে কবর দিয়ে দিব, শেখ মুজিবকে আমরা বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে দিব, জিয়া বাদ দিয়ে দিব-এসব বলে তারা যদি ডাক দিতো-আসুন আমাদের আন্দোলনে আর এ কথাটা বলতো ইসলামী ছাত্রশিবির আছে আমাদের ভ্যানগার্ড আপনারা আন্দোলনে আসনে। তখন দেখা যেত।

এসব কথা সেদিন (আন্দোলনের সময়) বললে না কেন? মিথ্যাবাদীরা, এদের কি হওয়া উচিত আমি জানি না। তবে আমার সন্তানদের খুব কঠিন বিচার হওয়া উচিত। শিক্ষা দেয়া উচিত যে তোরা এ দেশটাকে সর্বনাশ করতেছে এসব কথা বলে। কাজেই এরা এ দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। ফিলোসোফিক্যাললি-ইডোলজোক্যাললি কর্মসূচিগতভাবে ধোঁকা দিয়েছে। অথচ একটামাত্র স্লোগান ছিল- হাসিনা যাক আজরাইল আসুক। এক দফা এক দাবি হাসিনা তুই কবে যাবি? মানুষ মনে করেছে হাসিনা গেলে এ দেশ এমনিই থাকবে না। একটা মধ্যবর্তী সরকার আসবে। কলাগাছ বড় না বড় গাছ বড়? বড় গাছ হলো নির্বাচিত সরকার এটার বয়স ৫ বছর হলে কলাগাছের কয় বছর বয়স হওয়া দরকার? তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) ক্ষমতায় বসে থাকতে চায় কেন? আমার তো এটা ভালো লাগে না। আমি যে কথা বলতেছি কালকেই বলবে ফজলুর রহমান মুরতাদ, ইসলাম বিশ্বাস করে না।


ফজলুর রহমান তো ভারতের দালাল। যে সত্য কথা বলবে, যে নির্বাচন চাইবে সে ভারতের দালাল। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একটা সৎ মানুষ সত্য নিরীহ মানুষ, ভদ্র মানুষ এ দেশের রাজনীতিতে খুব কম আছে। সেই লোকটাকে প্রত্যেকদিন ওয়াজ মাহফিলে যে গালাগালি করা হয়, এটা কি দেশ? এরা আলেম? এরাই মৌলানা সাহেব? ফখরুল ইসলামের পাঞ্জাবির নিচে তো তোমরাই আশ্রয় নিয়েছিলা। বিএনপির কাপড়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এখন মুনাফেকি করতেছ যে। যার সহায়তায় তুমি চলছে, যার আন্ডারে আশ্রয় নিছে তারে খাইয়া ফেলবা? তুমি ফ্রাঙ্কেস্টাইন যে খেয়ে ফেলবা যে তোমাকে বাঁচিয়েছে। তারা যদি বলে ইসলামী শাসন, এসো ইলেকশন করি। দেখি যদি জামায়াতে ইসলামী বেশি সিট পায় মানুষ যদি তাদের নির্বাচিত করে তারা শাসন করবে দেশ। আমরা স্যালুট দিব।

কিন্তু এটা কি শুরু হয়েছে? ইলেকশন করা যাবে না। অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকব, সংস্কার করবো কীসের সংস্কার। কী সংস্কার? কে সংস্কার করবে? ড. আলী রীয়াজ? চল্লিশ বছর যাবৎ যে এ দেশের নাগরিক নাই। ওনি সংস্কার করবে আমার? ওনি কি বাংলাদেশের নাগরিক? আমার দেশের মানুষ নাই? আলী রীয়াজ তো আমাদের কর্মী ছিল। আলী রীয়াজের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সে আমার বন্ধু। আসেন আমার সামনে আলী রীয়াজকে আনেন। সে আমেরিকায় পড়তে পারে। আমার মেয়েও আমেরিকাতে ডক্টরেট করে কি হইছে? এ কারণে ওনি আমার দেশের সংবিধান লিখবে? কাজেই আমি মনে করি না এ দেশে যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাহাত্তরের সংবিধান মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক-আসলে কি তাই?

ফজলুর রহমান: না। পরিষ্কারভাবে বলছি, এটা রাজাকাররা বলে। যাদের পূর্বপুরুষ রাজাকার তারা বলে গেছে। এখন তাদের সন্তানরা বলে। মুজিবনগর সরকার ঘোষণা কি ছিল, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার। এটার সঙ্গে গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার প্রার্থক্য কী? তো একইতো। এগুলো যুক্ত হয়েছে। ওটাকেই তো এলাবরেশন করে এটা হয়েছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: সলিমুল্লাহ খানও আপত্তি জানিয়েছেন।

ফজলুর রহমান: সলিমুল্লাহ খান কি বলেছে, আমি ওনার ছাত্র হওয়ার যোগ্যতা রাখি না। আমি উত্তর দিব না। সলিমুল্লাহ খানরা অনেক মহান মানুষ। আমি সেদিকে যাব না। আমি সকাল-বিকাল দুই কথা বলি না। আমি সবসময় সকাল বিকালে এক কথা বলা মানুষ। আমার নাম ফজলুর রহমান, আমি কৃষকের ছেলে। ভাটি এলাকার টেপির চালের ভাত খাই। গাঙের মাছে দিয়ে তরকারি খাই। কাজেই আমি সকাল বিকাল দুই কথা বলি না; কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই তিনটা জিনিসকে এব্রিবিয়েশন করে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপ্রেক্ষতা এটার সঙ্গে ওটার কন্ট্রাডিকশনটা কি? কোনো কন্ট্রাডিকশন আছে? রাজাকাররা সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করার জন্য এগুলো বলে। আমি আবারও বললাম, রাজাকাররা অথবা তাদের অধঃস্তন পুরুষরা এসব বলে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ