জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের হিসাব-নিকাশ
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দুর্বল বিরোধী দল গঠিত হয়ে আসছে–যেটি এবার সম্ভবত হতে যাচ্ছে দুর্বলতম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩০টি আসন নিয়ে বিরোধী দলে ছিল বিএনপি। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টি আসন নিয়ে একইসঙ্গে সরকারে এবং বিরোধী দলের চেয়ারে বসে জাতীয় পার্টি। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২২টি আসন নিয়ে আবারও বিরোধী দলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি।
একাডেমিক্যালি মনে করা হয়, অন্তত ১০ শতাংশ আসন না থাকলে সেটি ঠিক বিরোধী দল নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৩০টি আসন না থাকলে তাকে বিরোধী দল বলা যায় না; কিন্তু এবার জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। সুতরাং তাকে বিরোধী দল বলা যাবে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। অন্যদিকে যে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন, তারাও মূলত আওয়ামী লীগেরই লোক। চাইলে তারা একটি জোট গঠন করে তাদের মধ্য থেকে একজনকে নেতা নির্বাচিত করে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারেন; কিন্তু সেটি তারা করবেন, নাকি ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টিই বিরোধী দলের চেয়ারে বসবে–সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়।
এমন প্রশ্নও আছে যে, বিরোধীদলীয় নেতার আসন কি এবার ফাঁকা থাকবে? বাংলাদেশে এর উদাহরণ আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আছে। গত দুই মেয়াদ ধরে ভারতের লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতার আসন শূন্য। কারণ সেখানেও মোট আসনের এক-দশমাংশ পেতে হয় বিরোধী দল হওয়ার জন্য। বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ভারতের লোকসভায় এ মুহূর্তে কংগ্রেস ওই অর্থে বিরোধী দলও নয়। সেখানে কোনো বিরোধীদলীয় নেতা নেই।
২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পরপর দুবার অনুষ্ঠিত লোকসভার নির্বাচনে ন্যূনতম এক-দশমাংশ আসন পায়নি কংগ্রেস। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে তারা পায় ৫১টি আসন; কিন্তু ৫৪২ আসনের লোকসভায় বিরোধী নেতা নির্বাচন করতে হলে কোনো দলের অন্তত ৫৫টি আসন থাকা দরকার। অন্যদিকে ৩০৩ আসনে জয় পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ক্ষমতাসীন বিজেপি। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ২৮২টি আসন। আর মিত্রদের নিয়ে তাদের আসন দাঁড়ায় ৩৩৬। ওই বছর ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করে ভারতের সবচেয়ে পুরোনো দল কংগ্রেস। তারা মাত্র ৪৪টি আসনে জয় পায়। যে কারণে কাউকে বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি ভারতের এই মডেলে যাচ্ছে?
প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল ২৯৩টি আসনে। ফলে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। বিরোধীদলীয় নেতার আসন ছিল শূন্য। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। ৩৯টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুটি অংশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এর মধ্যে মালেক গ্রুপ ৩৯টি এবং মিজান গ্রুপ ২টি আসনে জয়ী হয়।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে জাতীয় পার্টি। ৭৬টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ২৫১টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে জাতীয় পার্টি। ১৯টি আসন নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতা হন আ স ম আব্দুর রব। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম একটি কার্যকর ও শক্তিশালী বিরোধী দল গঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে। ১৪০টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। আর ৮৮টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ।
এরপরের সংসদে আবারও ছন্দপতন। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৭৮টি আসন পায় বিএনপি। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচন বয়কট করে। কোনো দলই বিরোধী দল গঠনের মতো আসন পায়নি। ফলে এই সংসদেও কোনো বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন না। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারও একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠিত হয়। এই নির্বাচনে ১৪৬টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আর ১১৬টি আসন নিয়ে বিরোধী দলে বসে বিএনপি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সংসদেই সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য ছিল।
২০০১ সালের পয়লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদেও সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ভারসাম্য ছিল। এই নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। আর ৬২টি আসন নিয়ে বিরোধী দলে ছিল আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২৩০টি আসন নিয়ে তারা সরকার গঠন করে। বিএনপি পায় মাত্র ৩০টি।
এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনে তারা ২৩৪টি আসনে জয়ী হয়। ৩৪ টি আসন নিয়ে বিরোধী দলে বসে জাতীয় পার্টি। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো একটি বিরোধী দল একই সঙ্গে সরকারেও ছিল। যে কারণে অনেকে এই সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে ‘সরকারি বিরোধী দল’ বলে অভিহিত করেন। পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদে বিরোধী দলের যে শক্তি তথা সরকারি দলের সঙ্গে যে ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল, সেটির ছন্দপতন হয় নবম সংসদে—যেটি একটি নতুন রূপ ধারণ করে দশম সংসদে। এমন অদ্ভুত বিরোধী দল বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর যে কোনো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশেই বিরল।
বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির মোটামুটি এরকম ভূমিকা অব্যাহত ছিল সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদেও। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আগের দুটি নির্বাচনেরও চেয়েও বেশি আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এবার তারা ২৫৮টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২২-এ। এবারের নির্বাচনে যা হয়ে গেছে অর্ধেক। অর্থাৎ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন।
বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় যে কার্যপ্রণালিবিধির দ্বারা, তার কোথাও বিরোধী দল সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই। অর্থাৎ তিনশ আসনের মধ্যে ন্যূনতম কতগুলো আসন পেলে তাকে বিরোধী দল বলা যাবে, কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, তার যোগ্যতা কী হবে—সে বিষয়েও স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তবে সংবিধান বা কার্যপ্রণালি বিধিতে সুস্পষ্ট বিধান না থাকলেও দীর্ঘদিনের রেওয়াজ এটি যে, অন্তত এক-দশমাংশ অর্থাৎ ৩০টি আসন না পেলে তাকে বিরোধী দল বল যায় না। অতএব, মাত্র ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবে কি না—সেটি এখন বিরাট প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অলরেডি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির তো অনেকেই জিতেছেন, চৌদ্দ দলেরও দুজনের মতো জিতেছেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তো দূরে নয়, যিনি লিডার অব দ্য হাউস হবেন, তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী, নতুন লিডার অব দ্য হাউস পরিস্থিতি, বাস্তবতা, করণীয়... অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবেন।’ তার মানে জাতীয় পার্টি ১১টি আসন নিয়ে বিরোধী দলে বসবে এবং জি এম কাদের বিরোধীদলীয় নেতা হবেন নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোট করে একটি নতুন ধরনের বিরোধী দল গঠন করবেন, সে বিষয়টি নির্ভর করছে সংসদ নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
আইনত, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা জয়ী হয়েছেন, তারা কোনো দলের সংসদ সদস্য নন। তবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি চাইলে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দলে যোগ দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি ওই দলের এমপি বলে বিবেচিত হবেন। অতএব, যে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তাদের বিরাট অংশই হয়তো সরকারি দলের এমপি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে যোগ দেবেন। আবার কেউ কেউ সংসদে বক্তৃতা দেয়া এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়ার আশায় স্বতন্ত্র হিসেবেই বিরোধী দলের চেয়ারে বসতে পারেন। নবম সংসদের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। যে কোনো বিষয়ে আলোচনা এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি সরকারি দলের এমপিদের চেয়েও অনেক সময় বেশি সুবিধা পেয়েছেন।
তবে এবারের সংসদে শেষ পর্যন্ত কারা প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করবে এবং বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা কঠিন। এবারের নির্বাচনে ৬২টি জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হওয়াটা যেমন নতুন ঘট্না, তেমনি সংসদের বিরোধী দল গঠন ইস্যুতেও নতুন কিছু ঘটে কি না, সেদিকে দেশবাসীর নজর থাকবে। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল থাকা খুব জরুরি। কেননা সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে আসনের ভারসাম্য না থাকলে সরকারি দল যা খুশি বলতে পারে, যা খুশি করতে পারে। সে কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য আসন প্রাপ্তির বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এবং ভোট অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হলে সরকারি ও বিরোধী দলের আসন প্রাপ্তিতে ভারসাম্য বজায় থাকে। পরিশেষে একটি কার্যকর সংসদ মানেই সেখানে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকবে এবং প্রাণবন্ত বিতর্ক হবে। অনেক সময় সংখ্যায় বিরোধী দলের সদস্য বেশি হলেও তাদের অব্যাহত বয়কটে সংসদ প্রাণহীন হয়ে যায়। আবার সংখ্যায় কম হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিরোধী দলের সদস্যরা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে সংসদকে প্রাণবন্ত করে রাখতে পারেন। অতএব, সংখ্যায় যাই হোক, দ্বাদশ সংসদে যারা বিরোধী দলের আসনে বসবেন, তারা সত্যিই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারছেন কি না, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে