Views Bangladesh Logo

শূন্যতা পূরণের অপেক্ষায় ক্রীড়াঙ্গন

Dulal Mahmud

দুলাল মাহমুদ

‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত তারুণ্যের উৎসবকে সামনে রেখে স্তিমিত হয়ে পড়া কোনো কোনো জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে অনেক দিন পর খানিকটা সক্রিয়তা দৃশ্যমান হয়। যদিও তাতে খেলার চেয়ে উৎসবের আমেজই অধিক ছিল। সে-ও তো হঠাৎ ঝলসে ওঠা আলোর মতো। এর আগে বিজয় দিবস উপলক্ষেও সীমিত পরিসরে কিছুটা তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়; কিন্তু বেশিরভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন রয়ে গেছে অন্ধকারে।

ক্রিকেট, ফুটবল, আর্চারি, দাবা, তায়কোয়ান্দো, ব্যাডমিন্টন, জিমন্যাস্টিকস, ভারোত্তোলন, হ্যান্ডবল, কুস্তি, স্কোয়াশ, রাগবির মতো হাতেগোনা কয়েকটি ফেডারেশন ছাড়া অধিকাংশই অনেক দিন ধরে ঝিমিয়ে পড়েছে। আকস্মিকভাবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ক্রীড়াঙ্গনে সৃষ্টি হয় মারাত্মক অচলাবস্থার। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ক্রীড়া ফেডারেশনে বড় ধরনের পালাবদল ঘটেছে। অনেক ফেডারেশনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পালিয়ে গেছেন কিংবা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
এ কারণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে অধিকাংশ ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন।

এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফ থেকে ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়। তারই আলোকে ২১ আগস্ট ক্রীড়া সংস্থাসগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠু, সক্রিয়, সচল ও নির্বিঘ্ন রাখার প্রয়োজনে বিদ্যমান আইন মোতাবেক সরকারের ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা ও উপজেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার বিদ্যমান কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। এই শূন্যতা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থায় নির্ধারিত ব্যক্তিদের নিয়ে সাত সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠন করার জন্য ২৮ আগস্ট নির্দেশনা দেয়া হয়। এই অ্যাডহক কমিটি গঠন প্রক্রিয়া ধীরগতির হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের ক্রীড়াঙ্গনে মন্থরতা দেখা দিয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়াঙ্গনকে ঢেলে সাজানোর জন্য ক্রীড়াঙ্গনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ২৯ আগস্ট সাবেক জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন জোবায়েদুর রহমান রানাকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি। সদস্য করা হয় সাবেক হকি খেলোয়াড় মেজর (অব.) ইমরোজ আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, ক্রীড়া সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ বুলবুল এবং ক্রীড়া সাংবাদিক মন্টু কায়সারকে; কিন্তু বুলবুলের কর্মকাণ্ডে সরকার বিব্রত হওয়ায় ১ অক্টোবর তাকে অব্যাহতি দিয়ে সদস্য করা হয় বিকেএসপির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মুনীরুল ইসলামকে।

বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণের মাধ্যমে জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে শুরু হয় সংস্কার প্রক্রিয়া। সবার আগে ৩ সেপ্টেম্বর অপসারণ করা হয় বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানকে। ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন ২০১৮-এর ২২ ধারা অনুযায়ী তিনটি ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে অপসারণ করা হয়। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সভাপতি পদ থেকে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি পদ থেকে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে অপসারণ করা হয়। অব্যাহতি দেয়া হয় ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে।

১০ সেপ্টেম্বর অব্যাহতি দেয়া হয় ৪২টি ক্রীড়া ফেডারেশন এবং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে। ফেডারেশনগুলো হলো ব্যাডমিন্টন, শুটিং, হ্যান্ডবল, জুডো, কারাতে, তায়কোয়ান্দো, টেবিল টেনিস, জিমন্যাস্টিকস, বাস্কেটবল, আর্চারি, বক্সিং, রাগবি, ফেন্সিং, ভারোত্তোলন, উশু, ক্যারম, সাইক্লিং, টেনিস, রেসলিং, রোলার স্কেটিং, ভলিবল, স্কোয়াশ র্যাকেটস, রোইং, অ্যাথলেটিকস, খো খো, বধির ক্রীড়া, মার্শাল আর্ট কনফেডারেশন আর অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক কমিটি অব বাংলাদেশ, বাশাআপ, বেসবল-সফটবল, সার্ফিং, মাউন্টেনিয়ারিং, চুকবল, সেপাক টাকরো, জুজুৎসু, প্যারা আর্চারি, কান্ট্রি গেমস, থ্রোবল, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো, ঘুড়ি ও খিউকুশিন কারাতে।

এ ছাড়া আগে থেকেই তিনটি ফেডারেশনের সভাপতি পদ শূন্য ছিল। ১১ সেপ্টেম্বর শরীর গঠন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সরকারের সাবেক যুগ্মসচিব শেখ হামিম হাসানসহ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মরত ১৬ জনকে বিভিন্ন ফেডারেশন থেকে অপসারণ করা হয়। তবে কেউ কেউ নিজ থেকে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। ২১ আগস্ট অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব মন্টু এবং ৪ সেপ্টেম্বর কারাতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ক্য শৈ হ্লা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। অর্থাৎ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বীকৃত ৫৫টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে অধিকাংশই এখন নেতৃত্বহীন। সব মিলিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে বড় ধরনের একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।

এই অবস্থা নিরসনে সার্চ কমিটির প্রস্তাবের আলোকে ১৪ নভেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন ২০১৮ এর ধারা ২১ মোতাবেক অর্পিত ক্ষমতাবলে এক প্রজ্ঞাপনে ব্রিজ, টেনিস, স্কোয়াশ, কাবাডি, অ্যাথলেটিক্স, বিলিয়ার্ড ও স্নুকার, বাস্কেটবল, দাবা ও হকি ফেডারেশনের বিদ্যমান নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে গঠন করা হয় অ্যাডহক কমিটি। ফলে কিছুটা হলেও ক্রীড়াঙ্গন অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে থাকে; কিন্তু নতুন কমিটি ঘোষিত না হওয়ায় অধিকাংশ ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন স্থবির হয়ে আছে।

এর কারণ প্রথমত, সভাপতি না থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে গুরুত্বপূর্ণ পদে শূন্যতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থ ছাড় না করায় কার্যক্রম চালাতে পারছে না। নির্ধারিত সময়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে অডিট রিপোর্ট জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২৯ অক্টোবর থেকে অর্থ ছাড়করণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় ৩২ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের। অর্থ আটকে যাওয়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলো হলো সাইক্লিং, উশু, দাবা, কাবাডি, কারাতে, স্কোয়াশ, শুটিং, অ্যাথলেটিক্স, গলফ, জিমন্যাস্টিক্স, রোইং, শরীর গঠন, ব্রিজ, বেসবল-সফটবল, সেপাক টাকরো, বাশাআপ, প্যারা আর্চারি, মাউন্টেরিং, থ্রো বল, কান্ট্রি গেমস, মার্শাল আর্ট, ঘুড়ি, কিকবক্সিং, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো, ব্যুথান, সার্ফিং, ইয়োগা, চুকবল, জুজুৎসু, খিউকুশিন, হকি ও টেনিস।

অবশ্য ইতোমধ্যে কোনো কোনো ফেডারেশনের অর্থ ছাড় দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অর্থ ছাড় না হওয়ায় বেশিরভাগ কর্মকর্তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। স্পন্সরের মাধ্যমে খেলা চালানোর তাগিদ পাচ্ছেন না। তৃতীয়ত, যে কোনো মুহূর্তে অ্যাডহক কমিটির ঘোষণা দেয়া হতে পারে, এই অপেক্ষায় অনেক ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা চুপচাপ অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়তর মনে করছেন। যে কারণে ক্রীড়াঙ্গনের বড় একটি অংশের সক্রিয়তা নেই। যত দ্রুত স্থবির হয়ে পড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনকে সক্রিয় করে তোলা হবে, সেই আলোকে ক্রীড়াঙ্গন পরিপূর্ণভাবে উজ্জ্বলতা ছড়াবে। এ ক্ষেত্রে যতই বিলম্ব করা হবে, ততই পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই শূন্যতা পূরণের অপেক্ষায় আছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ