যেমন আছেন হত্যা মামলার আসামি সাংবাদিকরা
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে বহু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। জানা গেছে এখন পর্যন্ত সারা দেশে ১০৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ভাসানটেক থানায় করা ফজলু হত্যা মামলায়ই আসামি করা হয়েছে ২৫ পেশাদার সাংবাদিককে।
এ ছাড়া ২৩ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় শিক্ষার্থী নাঈম হাওলাদার হত্যা মামলায় ৭ সাংবাদিকে আসামি করা হয়েছে। একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। অথচ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন মামলা হওয়া বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। হত্যা মামলার আসামি হওয়ার কারণে বর্তমানে চরম মানসিক অশান্তি ও অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন বলেও জানান তারা।
ভাসানটেক থানা করা হত্যা মামলার আসামি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঘটনার দিন ৫ আগস্ট সারা দিন আমি বাসায়ই ছিলাম। তাছাড়া আমি ভাসানটেকেই কখনো যাইনি। কীভাবে ও কাদের ইন্ধনে আমাদের পেশাদার সাংবাদিকদের এই মামলায় আসামি করা হয়েছে, তা বলতে পারছি না। এটা খুবই দুঃজনক ঘটনা। হত্যা মামলায় আসামি হয়েছি শোনার পর থেকেই চরম মানসিক অশান্তি ও অস্বস্তির মধ্যে রয়েছি। আমার পরিবারের লোকজনও মানসিক দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কে মধ্যে রয়েছে। কোনো অপরাধ না করে এমন মামলার আসামি হলাম। আমি বর্তমান সরকারের কাছে অনুরোধ করব, তারা যেন সাংবাদিকদের এসব মিথ্যা অভিযোগ ও মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও হত্যা মামলার আসামি সোহেল হায়দার চৌধুরী এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে চারটি হত্যা মামলা হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। কাকে হত্যা করা হয়েছে, বাদীই বা কে তাও জানতে পেরেছি অনেক পরে। এই অবস্থায় চরম অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। সব সময় একটা টেনশন কাজ করে।’ তিনি বলেন, ‘বৈষম্য নিরোধের জন্য আন্দোলন হয়েছে অথচ আমাদের অনেক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দিয়ে বৈষম্য করা হচ্ছে। আমি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি এসব হয়রানিমূলক মিথ্যা অভিযোগ থেকে সাংবাদিকদের অব্যাহতি দেয়া হোক।’
এই মামলার আসামি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শাহনাজ শারমীন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবের সামনে থেকে ও দুপুরের পর বঙ্গভবনের সামনে থেকে লাইভ রিপোর্ট করেছি। রাত ১১টা পর্যন্ত বঙ্গভবনের গেটেই ছিলাম। ফজলু হত্যার ঘটনায় আমি তাহলে কীভাবে জড়িত? নিহতের বড় ভাই মামলার বাদী মো. সবুজের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সে জানিয়েছে মামলার এজাহারে থাকা সাংবাদিকদের তিনি চেনেন না।
তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়ায়? আমাদের চেনে শুধু সাংবাদিক কমিউনিটিই। যারা যারা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির আগামী নির্বাচনে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী ও স্বাধীনতার সপক্ষের তাদেরই এই মামলা আসামি করা হয়েছে। গত দুই দশক ধরে আমরা যেসব সাংবাদিক সহকর্মীদের সঙ্গে চলছি তাদের মাধ্যমে এটা হয়ে থাকলে তা হবে আমার জন্য খুবই দুঃখের। কোনো দিন কারো উপকার ছাড়া ক্ষতি করিনি। তাই এই ঘটনায় যতটানা অস্বস্তির মধ্যে আছি তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছি।’
ভাসানটেক থানার হত্যা মামলার আসামি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ কাফি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও বিকেলে অফিসে ছিলাম। তাই ঘটনার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তবে মামলার কারণে মানসিক অশান্তিতে আছি। সাংবাদিকতায় মনোযোগ দিতে পারছি না। এটা খুবই কষ্টের।’ কাফি আরও বলেন, ‘ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির আগামী নির্বাচনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বেছে বেছে আসামি করা হয়েছে। বাদী আমাদের কি চেনে? চিনবেই বা কীভাবে। আমরাতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।’
ভাসানটেক থানার ফজলু হত্যা মামলায় আসামি সাংবাদিকরা হলেন- নঈম নিজাম, মনজুরুল আহসান বুলবুল, শ্যামল দত্ত, ফরিদা ইয়াসমিন, ওমর ফারুক, মনজুরুল ইসলাম, মনজুরুল বারী নয়ন, সোহেল হায়দার চৌধুরী, কুদ্দুস আফ্রাদ, অরুণ কুমার দে, মো. নুরুল হক, জিহাদুর রহমান জিহাদ, আব্দুল মজিদ, সাজ্জাদ আলম খান তপু, সৈয়দ শুক্কুর আলী শুভ, হায়দার আলী, আশিকুর রহমান শ্রাবণ, আলমগীর হোসেন, শরিফুল ইসলাম, মাইনুল আলম, জায়েদুল আহসান পিন্টু, আবদুল্লাহ আল কাফি, কবির আহমেদ খান, নুরুল ইসলাম হাসিব ও শাহনাজ শারমিন। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থানার নাঈম হাওলাদার হত্যা মামলার আসামিরা হলেন- একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, একাত্তর টিভির সাবেক বার্তা প্রধান সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সময় টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আহমেদ জোবায়ের, এটিএন নিউজের সাবেক বার্তা প্রধান মুন্নী সাহা, একাত্তর টিভির প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট ফারজানা রুপা, একাত্তর টিভির চাকরিচ্যুত হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান।’
এ ব্যাপারে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কেন ও কী কারণে তাদের হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে সেটা জানি না। এটা মামলার যারা করেছে তারা বলতে পারবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হলে তারা মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন। এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে সেটা আমি বলিনি। দায়ী না হলে তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে না।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল থেকে যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তাদের মধ্যে কোনো সাংবাদিকের নাম নেই।’ তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হলে মামলা থেকে তাদের নাম বাদ যাবে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে