Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে অবস্থানে আছে

Md. Fazlay Elahi  Tushar

মো. ফজলে এলাহী তুষার

শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

ক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি এখন যেমন বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়েছে, তেমনি আঞ্চলিক শত্রু-মিত্র দ্বারাও প্রভাবিত। চীন তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সঙ্গে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণ কমানোর চেষ্টা করছে। এই জটিল ভূরাজনৈতিক জালের কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে যার কৌশলগত মূল্য অসীম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গতিবিধি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা:
বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, চীন এবং মিয়ানমারের মধ্যে এবং বঙ্গোপসাগরে এর প্রবেশাধিকারের কারণে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। বিপুল জনসংখ্যা এবং আঞ্চলিক উদ্যোগগুলোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিগুলোর জন্য একটি ট্রামকার্ড হিসেবে আছে।

পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে চীন। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলে তার প্রভাব শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। এই বিনিয়োগগুলো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ, যা একটি বাণিজ্য পথ এবং কৌশলগত কেন্দ্রের নেটওয়ার্ক তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে। চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরসহ কৌশলগত বন্দরগুলোর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে তার অবস্থান প্রসারিত করার জন্য বাংলাদেশ চীনের পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মালাক্কা প্রণালির মতো সংবেদনশীল অঞ্চল এড়িয়ে চলতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগর গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ। মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের একটি মূল এলাকা বঙ্গোপসাগর। খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরোধী দলগুলোর সমর্থনে কাজ করছে এবং আটটি জাতিগত গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে, যা এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে এবং চীনের প্রভাব কমাতে সহায়ক। যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপকে, যা বাংলাদেশের অন্তর্গত, একটি সম্ভাব্য ঘাঁটি হিসেবে দেখছে, যেখান থেকে তারা মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও লজিস্টিক সহায়তা সরবরাহ করতে পারে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে অবস্থান বজায় রাখতে এবং বঙ্গোপসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে সক্ষম করবে।

শেখ হাসিনার পতন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা:
দীর্ঘদিন শেখ হাসিনার শাসনে ছিল বাংলাদেশ। কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব, ব্যাপক দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য তার সরকারকে তীব্রভাবে সমালোচিত হতে হয়েছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে তার শাসনামলে। তার ঘনিষ্ঠজনরাই অর্থ পাচারের জন্য দায়ী। দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে। এই দুর্বলতা বহিরাগত চাপকে বৈধতা দিয়েছে। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং চীনের সঙ্গে হাসিনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তার সরকার আন্তর্জাতিক সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।

শেখ হাসিনার পতন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ঘটতে পারে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংস্কারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধীপক্ষকে সমর্থন দিয়ে থাকতে পারে। যদি তাই হয়, এটা এই অঞ্চলের জন্য অনিশ্চয়তা নিয়ে আসবে। বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো কম কর্তৃত্ববাদী হবে, দুর্নীতি হ্রাসের দিকে বেশি মনোনিবেশ করবে; কিন্তু দেশের জটিল ভূরাজনীতি পরিচালনায়ে এই অন্তবর্তীকালীন সরকারের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বর্তমান সরকার কিছু রাজনৈতিক সংস্কারের আশা জাগিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে বর্তমান সরকার, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।

সরকার পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পুনর্গঠন আনতে পারে, যা হয়তো দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি আনবে, বা বা চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে। এই অনিশ্চয়তাও বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। বিশেষ করে যদি নতুন নেতৃত্ব দুর্নীতি কমাতে পারে এবং দেশকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। তবে এটি অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা চীনকে আরও নমনীয় প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার সুযোগ দিতে পারে।

ভারতের ভূমিকা এবং কৌশলগত উদ্বেগ:
আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে ভারতের। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এবং দেশের বাকি অংশের মধ্যে সংযোগের জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু (বন্ধুত্ব সেতু) উদ্বোধন করা হয়, যা আসলে এটাই প্রকাশ করে যে, ভারত বাংলাদেশ হয়ে তাদের পরিবহন সংযোগ বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করছে। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে কলকাতা পর্যন্ত পণ্য চলাচলের সময় ও পথ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে এই সেতুটি। ফলে বাংলাদেশ এবং তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সংযোগ উন্নত করতে এই সেতুটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

ভারতের প্রধান কৌশলগত দুর্বলতা হলো সিলিগুড়ি করিডোর, যা সাধারণত ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত। এই ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত পথটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। চীনের আগ্রাসনের জন্যও জায়গাটি অত্যন্ত সংবেদনশীল। চীন এরই মধ্যে অরুণাচল প্রদেশে প্রায় ৬০ কিলোমিটার ভারতীয় জমি দখল করেছে। যদি তারা আরও অগ্রসর হয়, তাহলে মুরগির গলা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। তাহলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা ভারতের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এবং নেপালে যদি চীন আরও প্রভাব বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তাহলে এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, যা দেশটির আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় বিরাট সমস্যা তৈরি করবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের পা বাড়ানো ভারতের জন্য সরাসরি হুমকি। কারণ, এই অঞ্চলে মূলত ভারত একাই রাজত্ব করতে চায়। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের বাংলাদেশ যে এখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়, কৌশলগত দিক থেকে ভারতের জন্য এটা মারাত্মক এক সমীকরণ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটা ভাসা ভাসা সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে; কিন্তু নতুন সরকার হয়তো ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক উন্নয়নে মনোনিবেশ করবে বেশি। ভারতও হযতো তার আঞ্চলিক কৌশল কিছু পরিবর্তন করবে। চীনের প্রভাব কাটাতে ভারত এখন আরও বেশি করে বাংলাদেশমুখী হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর ও দৃঢ় করতে বাধ্য হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভবিষ্যৎ:
বাংলাদেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক চিত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা দেশকে দুর্বল করে দিয়েছে। নতুন সরকারের ওপর দায়িত্ব অনেক। নতুন সরকার রাজনৈতিক সংস্কারের দরজা খুলে দিতে পারে। সবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আরও স্বচ্ছতা আনতে পারে। যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান কী হয় তার ওপর।

চীন সম্ভবত তার অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। বঙ্গোপসাগরে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তার কূটনৈতিক ও সামরিক অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দেবে। এমন একটি সরকার তৈরি করার চেষ্টা করবে, যা পশ্চিমা স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভারতও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখতে এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে তার সংযোগ নিশ্চিত করতে কাজ করবে।

এই জটিল আঞ্চলিক গতিশীলতার মধ্যে আগামী বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা কেমন থাকবে, তার অনেকটাই এখন নির্ভর করবে বাংলাদেশ সক্ষমতার ওপর। দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্ত হয়ে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে পারলে বাংলাদেশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে। তবে যদি রাজনৈতিক পরিবর্তন অস্থিতিশীলতা আরও বাড়ায়, বাহ্যিক হস্তক্ষেপ বাড়ায়, তাহলে এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাবে। ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে।

ক্রসরোডে বাংলাদেশ:
ভূরাজনৈতিক গতিপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরদশা দেশটিকে খুব দুর্বল করে ফেলেছে; কিন্তু তার সরকারের পতন এখন নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত একটি নতুন সরকার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে; কিন্তু একই সঙ্গে তাকে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। ত্রিমুখী সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষায় কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

বৈশ্বিক শক্তিগুলো যেহেতু প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করছে, তাই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূমিকা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দেশটি তার স্বাধীনতা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারবে কি না, তা-ই এখন দেখার বিষয়। এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করে বাংলাদেশের সক্ষমতার ওপর।

মো. ফজলে এলাহী তুষার: এফডিআই পরামর্শদাতা এবং সিনিয়র বিজনেস ম্যানেজার, চায়না শানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ লিমিটেড।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ