সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতার দোলাচল ও এ সময়ের বাংলাদেশ
সংবিধান সংস্কার, সংশোধন নাকি পুনর্লিখন- এ নিয়ে বিতর্ক চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। বিতর্কটি শুরু হয় মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজের একটি মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। গত ২৯ আগস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘বিদ্যমান সংবিধান সংশোধনের কোনো উপায় নেই। সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ এমনভাবে লেখা যে, তাতে হাত দেয়া যায় না। এখানে এমন বিষয় আছে যেগুলো না সরালে আপনি কিছু করতে পারবেন না।’
অধ্যাপক রীয়াজ যখন এই মন্তব্য করেন, তখনো তিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হননি। বরং প্রথমে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করা হয়; কিন্তু তিনি এই কমিশনে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে গত অক্টোবরে আলী রীয়াজকে প্রধান করে কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন এরই মধ্যে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। তাদের মতামত নিয়েছে। শতাধিক দেশের সংবিধান পর্যালোচনার পাশাপাশি ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিটি সংশোধনের আগে ও পরে যা যা ঘটেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করেছে। তারা জানুয়ারির মধ্যে সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে মোট ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে আছে আরও অনেক দফা ও উপদফা। সংবিধানের শুরুতে একটি প্রস্তাবনা এবং শেষে তপশিলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বিভিন্ন পদের শপথ ও ঘোষণা।
সংবিধান সংস্কার কমিশন এর প্রতিটি বিষয়ের ওপরে তাদের পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ দেবে বলে মনে করা হচ্ছে; কিন্তু তারা সুপারিশসহ এই প্রতিবেদন দেয়ার মধ্য দিয়ে সংবিধান পরিবর্তন হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। বরং বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের যে বিধান, তাতে একটি দাড়ি-কমা পরিবর্তন করতে হলেও সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন লাগবে।
সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে গণপরিষদ গঠন। অর্থাৎ আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনটি গণপরিষদ গঠনের জন্য হবে এবং সেই গণপরিষদেই সংবিধান সংস্কার, সংশোধন বা পুনর্লিখন হওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। এমনকি কমিশন প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজও সেটি মনে করেন; কিন্তু গণপরিষদ গঠন করতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের পতনের পরে এই মুহূর্তে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সায় ও সমর্থন ছাড়া গণপরিষদ গঠন সম্ভব নয়। অতএব সংবিধান সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দেবে, সেগুলোর ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে পরবর্তী সংসদে অনুমোদিত হতে পারে।
সুতরাং সংবিধানের কোথায় কোথায় পরিবর্তন আসবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় এটি হবে, তা এখনই বলা মুশকিল। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে এমন অনেক বিধান রয়েছে যেগুলো সাংঘর্ষিক এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসন বিকাশের অনুকূল। সেরকমই একটি বিধান রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার দোলাচল। এই ইস্যুতে সংবিধান সংস্কার কমিশন কী সুপারিশ করবে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটি ধারণা করা যায় যে, তারা অবশ্যই সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার যে সাংঘর্ষিক বিধান, সেটি সংস্কারে সুপারিশ দেবে।
কীভাবে এলো রাষ্ট্রধর্ম:
বস্তুত বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা ও বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ‘রাষ্ট্রধর্ম’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর নতুন রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান গৃহীত হয়, সেখানে রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছু ছিল না। বরং সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এমনকি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় দয়াময়ের নামে’ যুক্ত করার প্রস্তাব দিলেও সেটি গৃহীত হয়নি; কিন্তু এর কয়েক বছরের মধ্যেই সংবিধানের প্রস্তাবনায় যেমন ‘বিসমিল্লাহ’ যুক্ত করা হয়, তেমনি অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা হয় রাষ্ট্রধর্মের বিধান।
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ নম্বর-৪ এর দ্বিতীয় তপশিলবলে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির-রাহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) যুক্ত করা হয়- যাকে পরের বছর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল গৃহীত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়। এর ৩২ বছর পরে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা হলেও প্রস্তাবনা থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ বাদ দেয়া হয়নি। তবে এর অনুবাদে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এখন সংবিধানের শুরুটা এরকম: ‘বিসমিল্লাহির-রাহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।’
বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ২ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয় ছিল প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা। কিন্তু ১৯৮৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী এনে ‘২ক’ নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাষ্ট্রধর্মের বিধান করেন। সেখানে বলা হয়: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’
কেন বিধানটি বাতিল করা গেল না:
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়েও রাষ্ট্রধর্মের এই বিধান বাতিল করা হয়নি। তবে অনুচ্ছেদে কিছুটা সংশোধন আনা হয়। এখন এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বাক্যটা এরকম: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা না হলেও এই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে ইসলামের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মকে সমমর্যাদা দেয়া হয় এবং সব ধর্ম পালনে সবার সমঅধিকার নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। যদিও কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে অন্য ধর্মের সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য ২০১০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি করা হয়- যে কমিটি সংবিধান সংশোধনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে তার দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন, যেখানে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে তার দলের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘মানুষের ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয়।’ তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এখানকার সমস্যা হচ্ছে যাদের ধর্মে-কর্মে মন নেই, তারাই বেশি বেশি ধর্মের কথা বলেন। তবে ধর্ম বিষয়ে মানুষের অনেক আবেগও জড়িত। কাজেই রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি সংবিধান থেকে বাদও দেয়া যাবে না। তাই সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেন নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার সমানভাবে ভোগ করতে পারেন-সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি।’ ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করা হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা যৌক্তিক ছিল না। করা উচিতও হয়নি।’ (আমীন আল রশীদ, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী: আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক, ঐতিহ্য/২০১১, পৃ. ৬৪)।
বলা হয়, এরশাদ মূলত অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চেয়েছিলেন; প্রথমত, ইসলামের নাম ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের ধর্মভীরু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায় এবং দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তার সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেয়া। কেননা এরশাদ সরকার শুরু থেকেই বৈধতার সংকটে ভুগছিলেন। তার বৈধতার সংকট যেমন তীব্র ছিল তেমনি বিরোধীদের সঙ্গেও বিরোধ ছিল তুঙ্গে। বলা যায় এরশাদ সরকার যে দ্রুত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিতাড়িত হবার অবস্থায় উপনীত হয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এমন কিছু করার দরকার ছিল যাতে করে জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন কিছুটা হলেও ফেরত আসে। (কাজী জাহেদ ইকবাল, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনী: ১৯৭২-১৯৯৮ প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা, ধ্রুবপদ/২০১৬, পৃ. ৮৫)।
১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কিত সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিলটি যখন সংসদে উত্থাপন করা হয়, তখন এ নিয়ে দারুণ বিতর্ক হয়। যেমন বরগুনা-২ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনি অষ্টম সংশোধনীর বিরোধিতা করে একে ‘ফায়দা লোটার চেষ্টা’ বলে অভিহিত করেন। তিনি সরকারের কড়া সমালোচনা করে বলেন, ‘যে দেশে শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে, এরকম একটি নামকরণ করে সুড়সুড়ি দেয়ার অবকাশ কোথায়? এটা তো যে কোনো দিন সকালবেলা বলে দেয়া যেতে পারে যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আমরা তো সেটা পালন করছি। এখানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধিতা কেউ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি না; কিন্তু এটাকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’ মনি বলেন, ‘জামায়াত যদিও এটা সমর্থন করছে, এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সমর্থন করছে না। বিএনপি মাঝামাঝি সমর্থন করছে। একটা অনৈক্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা হচ্ছে। সাম্প্রদারিক দাঙ্গা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হচ্ছে এই বিলটির মাধ্যমে।’ এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানেরও আহ্বান জানান নুরুল ইসলাম মনি। (জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী, ১৯৮৮)।
সম্মিলিত বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘একটি ধর্মকে জোর করে কারও ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। কাউকে বিশ্বাসী করা যায় না। কাউকে জোর করে নামাজ পড়ানো যায় না, রোজা রাখানো যায় না, হজ, জাকাত কোনো কিছুই বাধ্যতামূলক করা যায় না। এগুলো সব একটি মানুষের আত্মার চাহিদা এবং সেই চাহিদা মোতাবেক একটি ঐশ্বরিক শান্তি পাবার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ ধর্মকে অনুসরণ করে এবং তার পূর্বপুরুষ থেকে যে ধর্মে অবস্থান করে সেদিকেই সে সম্ভবত প্রবাহিত হয়। তাই, আমি মনে করি যে, এখানকার মানুষ ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করলেই নতুন করে নামাজ পড়বে না। নতুন করে মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে উঠবে না।’
রাষ্ট্রধর্ম বিলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো এবং দীর্ঘ বক্তৃতা দেন বিরোধীদলীয় নেতা আ স ম আব্দুর রব। তিনি বলেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম পড়ে শুয়োর জবাই করলেই সেটা হালাল হবে না। এই সংসদে একজন সদস্য টুপি মাথায় দিয়ে ট্রেজারি বেঞ্চে বসে আছেন, কয়েকবার হজ করেছেন, হাজি আবদুল ওদুদ সাহেব, তার কাছে শুনেছি যে, পাকিস্তান আমলে একটি জেলা শহরে একটি ওষুধের দোকান ছিল, সেটার নাম ছিল ‘স্বদেশী ঔষধের দোকান’, এর নিচে আবার ছোট করে লেখা ছিল বিদেশি মদ পাওয়া যায়।’
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করার সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন দেশের ১৫ জন বরেণ্য ব্যক্তি। এর ২৩ বছর পরে ২০১১ সালের ৮ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ একটি রুল জারি করেন। ওইদিনই অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়। রুল জারির প্রায় পাঁচ বছর পরে ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ রুল শুনানির জন্য আদালতে ওঠে; কিন্তু ওইদিনই নাঈমা হায়দার, কাজী রেজা-উল হক ও মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দেন। এর ৮ বছর পরে ২০২৪ সালের ২৫ এপ্রিল ৫২ পৃষ্ঠার যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা হয়: ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে না’।
রাষ্ট্রধর্মের কুফল:
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে যে সাংঘর্ষিক অবস্থাটি জিইয়ে রাখা হলো এবং সর্বোচ্চ আদালতও যে বিধানটি বাতিল করলেন না, তার ফলে কী হয়েছে? যেসব দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম নেই, সেসব দেশের মানুষ সবাই ধর্মহীন বা যেসব দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম আছে সেসব দেশের মানুষ অনেক বেশি ধর্মভীরু? ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার আগে এই দেশের মানুষ কম ধার্মিক ছিল আর রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পরে বেশি ধার্মিক হয়েছে- বিষয়টি কি এরকম?
বরং কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার অর্থই হলো ওই দেশে বসবাসরত অন্য ধর্মের মানুষদেরকে সাংবিধানিকভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মকেই রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়, ফলে অন্য ধর্মের অনুসারীরা তখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হন। তখন এই সংখ্যাগুরুর দম্ভ এবং সংখ্যালঘুর বঞ্চনা রাষ্ট্রে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু জনগোষ্ঠীরও ওপর আক্রমণের যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার সব সত্য না হলেও বা প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টিকে রঙচঙ মাখিয়ে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করলেও কিছু বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিশেষ গত গত দুর্গাপূজার সময় দেশের অনেক জায়গায়ই হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন এবং তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দেয়ার নামে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও ব্যক্তির অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ডে হিন্দুরা বিরক্ত হয়েছেন। একটি ধর্মভিত্তিক দল হিন্দুদের মন্দির ও প্রতিমা পাহারা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে এই প্রশ্নও উসকে দিয়েছে যে, যে দেশের সংবিধানের মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’- সেই দেশে যদি মসজিদ ও গির্জা পাহারা দিয়ে রাখতে না হয়, তাহলে মন্দির পাহারা দিতে হবে কেন? এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে