সুন্দরবন ঘেঁষে অবৈধ রিসোর্ট তৈরি বন্ধ করুন
আমাদের দুর্বিনীত দুর্নীতিগ্রস্ত আচরণ কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, তার উদাহরণের শেষ নেই। আমরা নদী-খাল ভরাট করে দখল করেছি, পাহাড় কেটে সমতল বানিয়েছি, বন-জঙ্গল কেটে সাফ করে যা ইচ্ছা তা-ই বানিয়েছি। আমাদের চরিত্রের ভেতর লোভ, অসততা আর আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে প্রচণ্ড অব্যবস্থাপনা। ফলে নিজের লাভের জন্য দেশ-জাতি-পরিবেশের কথাও আমরা মাথায় রাখি না। যে কোনো সুযোগে যে কোনো জায়গা দখলের হাত বাড়িয়ে দিই, তাতে যে নিজের পায়ের নিজে কুড়াল মারি সে কথাও খেয়াল রাখি না।
সুন্দরবন শুধু আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ না, আমাদের রক্ষাকারী। সমুদ্রের অনেক ঘূর্ণিঝড় থেকে সুন্দরবন আমাদের বাঁচায়। এ বনের জীবনবৈচিত্র্যও বিশ্বে বিরল। এমন অনেকরকম মাছ ও পাখি আছে, যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায় না। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা আর না বলাই ভালো। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এমন কাণ্ডই করছি, যেন সুন্দরবন থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুন্দরবনের কাছে আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়েছি। যা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এর মধ্যে আরেকটি খবর আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলল- সুন্দরবন ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে অবৈধ রিসোর্ট, যার জন্য জীববৈচিত্র্য রয়েছে হুমকিতে।
গতকাল শনিবার (২ নভেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই সুন্দরবনের খুব কাছেই গড়ে উঠেছে ২৩টি কটেজ ও রিসোর্ট। ইকো কটেজ ও ইকো রিসোর্ট নাম দেয়া হলেও এগুলোতে রয়েছে এসি, জেনারেটর ও সাউন্ড বক্স। এতে রিসোর্টগুলোর আশপাশে বাড়ছে পানিদূষণের পাশাপাশি মাটি ও শব্দদূষণ। হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী; কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সুন্দরবন ঘেঁষে কেন রিসোর্ট বানাতে হবে? অনেক পর্যটক সুন্দরবন বেড়াতে যান, ঠিক আছে, সারা দিন ভ্রমণ করে তারা সন্ধ্যায় শহরে চলে আসবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাদের জঙ্গলের কাছে থাকা কী দরকার? রিসোর্ট তো বাংলাদেশে অসংখ্য হয়েছে। গাজীপুরের শালবন শেষ হয়ে গেছে রিসোর্টে। প্রচুর রিসোর্ট গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহ, শেরপুরের গাড়ো পাহাড়ে। এখন প্রচুর রিসোর্ট গড়ে উঠছে সিলেট, শ্রীমঙ্গল, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলেও। বাংলাদেশে বর্তমানে রিসোর্টের এক বিপুল বাণিজ্য-সম্ভার গড়ে উঠেছে। পর্যটন বাড়ানোর জন্য এই উদ্যোগ ভালো, খারাপ না। শহরাঞ্চলের অনেক মানুষ একটু নিরিবিলি গিয়ে কোথাও থাকতে চায়; কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থার কথাটাও তো আমাদের ভাবতে হবে।
প্রকৃতির ক্ষতি করে তো আমরা ব্যবসা চালাতে পারি না। বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো একটি জায়গায়। সুন্দরবন তো গাজীপুর শালবন না। সুন্দরবনের মতো জায়গায় অবৈধ রিসোর্ট গড়ে উঠে কী করে! খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকা ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’। এই এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর তার মানে প্রশাসনও কতটা অন্ধ ও দুর্নীতিগ্রস্ত! বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী বাবুল হাওলাদার বলেন, কটেজগুলো বনের জমির মধ্যে না হলেও সেগুলোর প্রধান উপজীব্য বন।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দোর দাবি, কটেজ ও রিসোর্টগুলো বনের বাইরে। বিষয়টি দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কটেজ-রিসোর্ট আইনের আওতায় আনার জন্য ‘সুন্দরবন ইকো ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান’ প্রণয়ন করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। আমরা চাই, এই অবৈধ রিসোর্টগুলোর ব্যাপারে শিগগিরই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। সুন্দরবন ঘেঁষে শুধু অবৈধ নয়, বৈধ রিসোর্টও যেন গড়ে উঠতে না পারে, সে ব্যবস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরকে করতে হবে। যে কোনো মূল্যে সুন্দরবনকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে। রক্ষা করতে হবে এর বিস্ময়কর অতুলনীয় জীববৈচিত্র্য।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে