গ্যাং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সহিংসতা বন্ধ করুন
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সহিংসতা গড়ে ওঠার কথা আমরা জানি। সম্প্রতি এটা খুব উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাং খুব সক্রিয় হয়ে উঠছে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় কিশোর ও যুবকদের গ্যাংগুলো সক্রিয়। মাদকদ্রব্য গ্রহণসহ এরা নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সাধারণ মানুষকে নানাভাবে উত্যক্ত করা, প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে মারামারি করা এদের কাজ। নানারকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি তারা অন্য পক্ষের সঙ্গেও যখন-তখন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। প্রতিটি গ্রুপের আবার আলাদা ‘ট্যাগ মার্ক’ আছে।
গ্যাং দলগুলোর নামগুলোও অদ্ভুত আর চমকপ্রদ। যেমন, একে-৪৭, সেভেন স্টার, ফ্রেন্ড গ্যাং ইত্যাদি। ধারণা করা হয় এরা এই নামগুলো নেয় বিভিন্ন ভৌতিক চলচ্চিত্র, ভিডিও গেমস এবং ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশন শোগুলো থেকে। এরা প্রায় নিয়মিতই বেআইনি কাজকর্মে যুক্ত থাকে। হত্যা-খুন, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এদের নিত্যকর্ম। গ্যাং দ্বন্দ্বে খুনের খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসে। সম্প্রতি এমনই আরেকটি খবর এসেছে, গুলশানে ইন্টারনেট ব্যবসায়ী হত্যায় ‘একে-৪৭’ গ্যাং জড়িত। গতকাল শনিবার (২৩ মার্চ) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে গুলশানে যাকে গুলি করে মারা হয়, এই খুনের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ গ্যাং-দ্বন্দ্ব ছিল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সুমন মিয়া চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫ আগস্টের পর নিজস্ব গ্যাং গ্রুপ খোলেন। প্রভাব বিস্তারের জন্য নিজেকে যুবদল নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি আগে একে-৪৭ গ্রুপের হয়ে কাজ করতেন, সেখান থেকে বেরিয়ে ‘বন্ধু গ্যাং’ গড়ে তোলেন। ফলে একে-৪৭ গ্রুপের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। মূলত এলাকার চাঁদাবাজি, আধিপত্য ও ফুটপাত বাণিজ্য নিয়ে দুদ্রুপের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। এই দলগুলো চাঁদাবাজি, টেন্ডারের কারসাজি এবং অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবসায় জড়িত ছিল। পুলিশ ও এলাকাবাসীর মতে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এরা প্রায়ই স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকদের লক্ষ্য করে চাঁদাবাজি চালায়।
আমরা জানি, এই গ্যাংগুলো পরিচালিত হয় রাজনৈতিক জোরেই। বিগত আওয়ামী লীগ আমলে তা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও এরকম হচ্ছে কেন? তাহলে এখনো সেই পুরোনো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিই বহাল আছে? তাহলে কী লাভ হলো এত প্রাণের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থানে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এখন তো কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় নেই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়, এই গ্যাংগুলো তাহলে শক্তি পায় কোথায়? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বা কেন ব্যর্থ হচ্ছে এই গ্যাং দমনে?
গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে মূলত দায়ী আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়। বর্তমানে নানাবিধ সামাজিক সমস্যাগুলো আমাদের মধ্যকার সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ঐক্য এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রধান উপাদানগুলোকে ক্রমেই গ্রাস করছে। সমাজ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। কার্যত সমাজের অচলায়তন ও অধঃপতনের ক্রমধারা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে। যদি আমরা এখনই এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, বলাই বাহুল্য যে এর খেসারত অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে। গ্যাং অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন এর মূল কারণটি খুঁজে বের করা। এবং কোনোভাবেই যেন তারা রাজনৈতিক ছায়ায় বেড়ে উঠতে না পারে সেদিকে নজর রাখা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে