চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধ হোক
ভাত বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। প্রতিদিন তিনবেলা তারা ভাত খায়। ভাত বাঙালির জন্য এমনই বিশেষ খাদ্য যে, তারা যদি একবেলা পোলাও খায়, পরের বেলা ভাত চায়; কিন্তু দিন দিন চালের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভাত খাওয়া সামনে অসম্ভব হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা জানতে পারলাম, আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েই চলেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক মাস ধরে প্রায় সব ধরনের চালের মূল্যই বেড়েছে। মাঝারি মানের চালের মূল্য এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি, গত বছরও যার মূল্য ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আর একটু ভালো চাল হিসেবে যেগুলো পরিচিত, মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মূল্য ৭০ থেকে ৮৪ টাকা কেজি, ১ বছর আগে যেগুলোর মূল্য ছিল ৬০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি।
নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো সাধারণত মোটা বা মাঝারিমানের চালই ক্রয় করেন। সরু চাল খান মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তরা। নিম্ন আয়ের মানুষেরও এখন কেজিপ্রতি ৬০ টাকার অধিক মূল্যে চাল কিনতে হয়। যখন কোনো কোনো পরিবারের দৈনিক আয় তিন-চারশ টাকা, তখন তারা ষাট টাকা কেজিতে কীভাবে চাল কিনবেন? দেখা যাচ্ছে আয়ের অর্ধেকটাই তাদের ব্যয় করতে হয় চাল কেনার পেছনে। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে মোটা চালের মূল্য ছিল মাত্র ৪০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সার, জ্বালানি তেল আর বিদ্যুৎ মূল্য বাড়িয়েছে।
এই অবস্থায় নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন ভয়াবহ অনিশ্চয়তায়। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যদ্রব্যের মূল্য চড়া, তার ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে চালের মূল্য। মধ্যবিত্তরাই যেখানে বাজারদর মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, নিম্ন আয়ের মানুষ তখন কী করবে? তারা বেঁচে আছেন খেয়ে না খেয়ে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ মানুষই এখন খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিবিএসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি পাঁচজনের একজন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমনের ভরা মৌসুমে কেন চালের এমন মূল্য বৃদ্ধি? মধ্যবিত্তের চালের বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করে মূলত বড় বড় কিছু মিল, যারা নিজেদের ব্র্যান্ড নামে চাল বাজারে ছাড়ে। মিলগুলো সব সময় ধানের চড়া দাম ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়াকে চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী করে আসছে। নতুন করে চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানিয়ে অটো রাইস মিলের মালিকরা বলেছেন, গত বছর সরকার ব্যাপক চাপে রেখেছিল, যাতে দাম না বাড়ে। সেই প্রভাব এখন পড়ছে। এ বছর প্রায় সব ধান বড় কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছে। সাধারণ মিলমালিকরা ধানই পাচ্ছেন না। তাই গত বছরের চেয়ে এবার ধানের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেশি।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধানের দামের চেয়ে চালের দাম অনেক বেশি বাড়ে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রতি কেজি মাঝারি বোরো ধানের পাইকারি দর ছিল ২৭ টাকার মতো। সেটা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৩০ টাকার কিছু বেশি। এ সময়ে ধানের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশের কিছু বেশি। বিপরীতে একই সময়ে খুচরায় সরু চালের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের চালের বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ঢুকেছে। তাদের কাছে অর্থের কোনো অভাব নেই। বিপুল পরিমাণ ধান মজুত করে বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা চাইলেই ব্যাংকের ঋণ পায়। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে তাদের প্রতিযোগিতায় ফেলা গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো; কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর কোনো বাজারকৌশল না নিয়ে লোক দেখানো অভিযানে বেশি আগ্রহী ছিল।
যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেয়ায় এখন বিদেশ থেকে চাল আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এখন চালের দাম প্রতি টন ৫০০ ডলারের আশপাশে, যা গত বছরের চেয়ে টনে ১০০ ডলারের মতো কম; কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এই দরেও চাল আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কারণ, ডলারের দাম এখন ১২৩ টাকা। বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা সরকারের একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বড় মিলমালিকরা যখন দেখেন বিদেশ থেকে আমদানির সুযোগ নেই, তখন ইচ্ছামতো দাম বাড়ান। তিনি বলেন, চাল আমদানি নিষিদ্ধ রেখে, উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে বড় ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন তাদের খরচ কত, কত দামে বিক্রি করেন, মজুত কত- এসব বিশ্লেষণ দরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সেদিকে কোনো আগ্রহ আছে?
এর মধ্যে, মিয়ানমার থেকে সরকারি আমদানির ২২ হাজার টন চাল নিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ ভিড়েছে। সেই চাল খালাস করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবার ৮ লাখ টন চাল আমদানি করবে সরকার। চাল আমদানির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা আশা করি, সফল হবে। সরকারিভাবে ভারত ও মিয়ানমার থেকে চাল আসছে। পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন আমদানি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। চাল আমদানির জন্য আরও উৎস সন্ধান করা হচ্ছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
যখন কোনো কিছুর দাম বাড়ে তখন সরকার নানারকম আশার বাণী শোনান, কিছু ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন, কিন্তু তারপরও দেখা যায় দাম কমে না। কোনো স্থায়ী সমাধান না টেনে সাময়িক সমাধান দেয়া হয়। চালের মূল্য নিয়ে বাংলাদেশে চালবাজি চলছেই। আমরা চাই চালের মূল্য বাড়ানো নিয়ে চালবাজি বন্ধ হোক। আমাদের দেশের মানুষ ভাতের ওপর নির্ভরশীল। চাল নিয়ে চালবাজি মূলত তাদের জীবন নিয়ে খেলা। এই খেলা বন্ধ করা হোক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে