রাসেলস ভাইপার নিয়ে গুজব বন্ধ করুন
বেশ কয়েকদিন ধরে রাসেলস ভাইপার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যে কোনো সাপকেই রাসেলস ভাইপার হিসেবে চিহ্নিত করে ছবি তুলে বানোয়াট গল্প বলে এ আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, রাসেলস ভাইপার পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র ও বিষাক্ত সাপ। এই সাপ কামড়ালে আর বাঁচানোর সম্ভাবনা নেই। ভিউ বাড়ানোর জন্য কিছু সংবাদমাধ্যম এতে তাল দিচ্ছে; কিন্তু সর্প বিশেজ্ঞদের মতে, বিষাক্তর দিক দিয়ে এ সাপ পঞ্চম। বাংলাদেশে এর চেয়ে অনেক বিষাক্ত সাপ আছে। আর এ সাপ ঘরবাড়িতে হানা দিয়ে কামড়ায় না। এরা সাধারণত জলাভূমিতে থাকে। এর ওপর আঘাত এলেই কেবল এই সাপ ছোবল দেয়। এ সাপ কামড়ালে ১০০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতভাগ, যদি সাপে কাটা রোগীর অন্য কোনো জটিল রোগ না থাকে।
গতকাল সোমবার (২৪ জুন) পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, সাপ দেখলেই এখন মেরে ফেলছে মানুষ। বন বিভাগ জানিয়েছে, প্রতিদিন হত্যার শিকার সাপের ৮০ শতাংশই নির্বিষ। এগুলোর মধ্যে একটিও নেই রাসেলস ভাইপার। রাসেলস ভাইপারের আতঙ্কে উপকারী সাপ পর্যন্ত মানুষ মেরে ফেলছে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট পাঁচটি হটলাইন চালু করেছে। প্রতিটি নম্বরে ঘণ্টায় গড়ে ৪০টি করে কল আসে। দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ কল করে সাপের সন্ধান দিচ্ছেন।
এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কারণ গুজব। সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ভেনম রিসার্চ সেন্টার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গুজবের ক্ষেত্রে পুরোনো ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে রাসেলস ভাইপার থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই, সে জায়গারও সাপটি দেখানো হচ্ছে ছবিতে। এমন সব প্রজাতির সাপের ছবি প্রচার করা হচ্ছে, যার কোনো অস্তিত্বই বাংলাদেশে নেই। সামাজিক মাধ্যমে রাসেলস ভাইপার নিয়ে কোনো পোস্ট দেওয়ার আগে জেনে বুঝে করতে পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
চন্দ্রবোড়ার ইংরেজি নাম রাসেলস ভাইপার। সতেরো শতকের শেষের দিকে এই উপমহাদেশের সাপের শ্রেণিবিন্যাসের বা ক্যাটালগিংয়ের কাজ শুরু করেন স্যার প্যাট্রিক রাসেল। তাই আঠারো শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় রাসেল সাহেবের সতীর্থ বিজ্ঞানীরা তার নাম জুড়ে দেয় এই সাপটির সঙ্গে। সেই থেকে চন্দ্রবোড়া হয়ে যায় রাসেলস ভাইপার। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া, বোড়া বা উলুবোড়া) দেখা যাওয়ার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এবং জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ সম্পর্কে সাবধানতা ও সচেতনতার জন্য বিবৃতি দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, মানুষের সঙ্গে এ সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সাপ সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপজঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে। রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চন্দ্রবোড়া সাপ কবে প্রথম দেখা গিয়েছিল, সে ইতিহাস অজানা। তবে সাম্প্রতিককালে এই সাপ কেন বাড়ছে, তার সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, ‘গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি- এদের শিকার ছিল চন্দ্রবোড়া। এখন গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি কমে গেছে বা কোথাও কোথাও নাই বললেই চলে। প্রধান শত্রুগুলো কমে যাওয়ায় চন্দ্রবোড়া বৃদ্ধির কারণ বলে আমরা মনে করছি। তবে আরও গভীর অনুসন্ধান দরকার।’
রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্ক কমানোর জন্য সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি এই সাপের উৎপাত যেন আর না বাড়ে সে ব্যবস্থাও করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে