ঢাকা ওয়াসার মিটার রিডারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করুন
ঢাকা ওয়াসা ১৩ বছরে অন্তত ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে; কিন্তু সেই তুলনায় পানি সরবরাহের মান বাড়েনি, বরং বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি। তাদের আলোচিত দুর্নীতির নাম মিটারে জালিয়াতির ফাঁদ। মিটারে দুর্নীতি যেন বাংলাদেশের একটা দুর্ভাগ্যজনক নিয়তি। বিদ্যুৎ মিটারে এক সময় জালিয়াতির ফাঁদ ঘাপটি মেরে ছিল। সাধারণ একজন মিটার রিডারকেও কোটি কোটি টাকার মালিক হতে দেখা গেছে। এখন সেটা দেখা যাচ্ছে- ওয়াসার পানির মিটারে, যা দেশের জন্য অনভিপ্রেত।
গতকাল মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ওয়াসার অসাধু মিটার রিডারদের হাতে পড়ে বাণিজ্যিক ভবন হয়ে যাচ্ছে আবাসিক ভবন। প্রতিবেদনটির সরেজমিন তথ্যমতে, একটি ১০ তলা ভবনে দোকান, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই আছে; কিন্তু মাস শেষে পানির বিল আসছে একটি আবাসিক ভবনের। লাখ টাকার বিল ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে দুই-চার হাজার টাকায়। আবার অভিযোগ আছে, কেউ কেউ মিটার খুলে রেখে পানির বিল কমিয়ে দেয়। গভীর নলকূপের তথ্য লুকাতে কেউ হয়ে ওঠেন ‘গভীর জলের মাছ’। ওয়াসার পানি ব্যবহারে এমন ছলাকলায় খোদ মিটার রিডাররাই অতিশয় দক্ষ। পানির বিল নিয়ে রকমারি কাণ্ড করে ফায়দা লুটছেন ওয়াসার এসব অসাধু বিলিং সহকারী; করছেন নিজের পকেট ভারী।
ঢাকা ওয়াসার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ভবনের নির্মাণকাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পানির বিল হবে বাণিজ্যিক হারে; কিন্তু দেখা যায়, তথ্য গোপন রেখে বিল গায়েব করে দেয়া হয়। ভবন নির্মাণের পানি কোত্থেকে এলো, কীভাবে এতদিন চলল এ নিয়ে তদন্ত করে পাওয়া যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, ভবন মালিক ও ওয়াসার মিটার রিডার যোগসাজশে এ কাজ হয়ে থাকে। ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এসব কারসাজির লাগাম টানতে তিন মাস অন্তর মিটার রিডারদের এলাকা বদলের নির্দেশনা থাকলেও অনেকে বছরের পর বছর খুঁটি গেড়েছেন। ফলে পানির বিল নিয়ে অনিয়মের বল্গা ছুটছেই। একদিকে যেমন মিটার রিডারদের হাতে সীমাহীন বিল চুরি হচ্ছে, অন্যদিকে রাজধানীর অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে পানির সংকট।
রোজার শুরু থেকেই গরম বাড়তে শুরু করেছে। এই সময়ে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মালিবাগ, গুলবাগ, শেওড়াপাড়া, লালবাগ, রায়েরবাগ ও দক্ষিণখান এলাকায় সমস্যা বেশি। ফলে রমজান মাসে পানির কষ্টে পড়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। তবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, সার্বিকভাবে পানি সরবরাহে ঘাটতি নেই, এলাকাভিত্তিক কিছু সমস্যা রয়েছে। ফলে ঢাকা ওয়াসা ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য বিপরীতমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যগুলো রয়েছে, তার মধ্যে ৬ নম্বরে রয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই মনে রাখতে হবে, পানি সরবরাহ অতি জরুরি একটি সেবা। কোনো কারণে এই সেবায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেটির প্রস্তুতি থাকা উচিত।
মূলত পানি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে এমন সব সমস্যা তৈরি হয়েছে এবং বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ওয়াসার পানি মনিটরিং সিস্টেমে যেমন সমস্যা আছে, এর পাশাপাশি বাসাবাড়ির মালিকদেরও কিছুটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই পানি সরবরাহে ওয়াসার মনিটরিং সিস্টেম কার্যকর করতে হলে বিদেশি সফল মডেলগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। এই সিস্টেমটি যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে সরকারকে।
এমতাবস্থায় আমরা বলতে চাই, ‘পানির অপর নাম জীবন’ সেই পানি নিয়ে এমন মরণঘাতী খেলা বন্ধ হোক। মিটার দুর্নীতি একদিকে যেমন রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ে ক্ষতি করছে, অন্যদিকে মানুষের জীবনেও দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। তাই অনিয়ম-অভিযোগের নিরসন ঘটিয়ে পানি সরবরাহে ওয়াসা নিয়মনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে- সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে