হামলা-ভাঙ্চুর থামিয়ে মানুষের উদ্বেগ দূর করুন
গত কয়েক দিনে সারা দেশে এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে, যা কারও কাছেই কাম্য ছিল না। মব-জাস্টিসের এক চরম আস্ফালন আমরা প্রত্যক্ষ করলাম দেশজুড়ে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তিন দিন ধরে বিভিন্ন স্থাপনা ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ভীতির সঞ্চার হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে দুই দিনে তিনটি বিবৃতি দিতে হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও জনগণকে শান্ত হওয়ার জন্য এবং সরকারকে কাজ করতে দিতে আহ্বান জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তবে ঘটনা পুরোপুরি থামানো যায়নি।
দেশে এমন একটা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয় মাসের মাথায়, যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। আজ শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, এমন পরিস্থিতির জন্য গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যমূলক ও উসকানিমূলক বক্তব্যকে দায়ী করা হয়। নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার ভাষণ প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। যার জেরে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ছয় মাস পূর্তির দিন ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ শুরু করেন।
কার উসকানিতে কারা তাণ্ডব চালিয়েছে এই প্রশ্ন এখন অমূলক। কারণ এটা আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম নৈরাজ্যকে যেমন একদিকে তুলে ধরেছে, অন্য দিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের ভাবমূর্তিকে অনেক ক্ষুণ্ন করেছে। উসকানি দাতারা হয়তো এটাই চেয়েছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করেই এই ভাঙচুরের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় কথা, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ দেশের বর্তমান সরকারের ওপর অনেকখানি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই হামলা, ভাঙ্চুরের ঘটনায় এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, মবজাস্টিস নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তি বর্তমান সরকারের নেই। এবং একটা দেশে যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন নাজুকভাবে ভেঙে পড়ে তখন এর চেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় আর কিছু হয় না।
প্রয়োজন ছিল গণহত্যাকারী ফ্যাস্টিস্ট সরকারের বিচারের দাবি জোরদার করা, যেভাবেই হোক পলাতক অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে, দেশে এনে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা, কিন্তু সেসব না করে বাড়িঘর ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে যে ক্ষোভ-আক্ষেপ প্রকাশ হলো তাতে শুধু বিপুল শক্তিরই অপচয় হয়নি, অনেক সম্পদেরও অপচয় হয়েছে; এবং অপরাধীরাই এ ক্ষেত্রে অনেকখানি সহানুভূতি অর্জনের সুযোগ পেয়েছে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক ও আইনগত সমস্যাকে রাজনীতি ও আইন দ্বারাই সমাধান করতে হবে; গণবিচারের মধ্য দিয়ে তার বিচার হলে কখনোই সমাধান বয়ে আনবে না।
আরেকটা গুরুতর বিষয়, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে যে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা ও অনিশ্চিয়তা ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে তা ঘুচানোও সহজ হবে না। আমরা দেখেছি বিগত গণঅভ্যুত্থানে যারা সামনের সারির আন্দোলনকারী ছিলেন, জীবনবাজি রেখে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তারা এসব ঘটনার সমালোচনা করেছেন, এবং বর্তমান হামলাকারী ও সমর্থনদাতাদের মাধ্যমে তারাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন। এই বিভাজন রেখা আমাদের ঘুচাতে হবে। সরকারকে যেমন এসব ঘটনা আরও শক্তহাতে মোকাবিলা করতে হবে; পাশাপাশি বিক্ষোভকারী বা বর্তমান আন্দোলনকারীদেরও আরও সচেতনতা ও যৌক্তিকতার সঙ্গে এসব ঘটনা সামাল দিতে হবে।
প্রথমেই ভেবে দেখতে হবে, কোন ঘটনায় কার লাভ বেশি। সবার আগে দেশের সার্থ রক্ষা করতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজের বিরুদ্ধে লড়লে হবে না। সাম্প্রতিক ঘটনায় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মনে যে ভয়-ভীতি-নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে তা দূর করতে সরকারকে যেমন সচেতন হতে হবে, আন্দোলনকারীদেরও সচেতন হতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, পরাজিত শক্তি উসকানি দিবেই; যতক্ষণ তারা বিচারের আওতায় না আসছে ততক্ষণ আমাদের উত্তেজিত করতে বক্তব্য দিবে- তাদের উসকানিতে কান দিয়ে আমাদের নিজেদের ঐক্য নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে