ঝড়ঝাপটা তো আসবেই, তারপরও ইতিহাস গড়বেন জেসিরাই
এ দেশে যে কোনো বিষয় নিয়ে মাতামাতি বা হুল্লোড় না হওয়াটা অস্বাভাবিক। মোটামুটিভাবে নিজের বিষয় ছাড়া আর সব প্রসঙ্গ নিয়ে মতামত দেওয়া বা পাণ্ডিত্য জাহির করার ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের তুলনা মেলা ভার। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর নিজেকে মেলে ধরার ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতাই নেই। ইচ্ছে হলেই যা খুশি প্রকাশ করা যায়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো জানাশোনা কিংবা চিন্তাভাবনার প্রয়োজন পড়ে না। খুব মামুলি বা সাধারণ ঘটনা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে দারুণভাবে ঝড় তোলা হয়। আর ধর্ম, রাজনীতি, নারী আর হাল আমলে ক্রিকেট তো হট আইটেম। এর মধ্যে যে কোনো একটি বিষয় বাগে পেলে আগুনে রীতিমতো ঘৃতাহুতি পড়ে। কোনো যুক্তি বা বিবেচনা বোধ কাজ করে না। অধিকাংশের মনোভাব এমন, বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার। যে কারণে যুক্তির চেয়ে কুযুক্তি তুলে ধরতে বিবেকে একটুও বাধে না।
একজন নারী আম্পায়ার ঢাকার মাঠে প্রথমবার পুরুষদের ক্রিকেট ম্যাচ পরিচালনা করবেন, তা নিয়ে হৈচৈ হবে না, এমনটা ভাবা বোকার স্বর্গে বসবাস করার শামিল নয় কি! গত ২৫ এপ্রিল মিরপুর শের-এ-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটের সুপার লিগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের মধ্যেকার ম্যাচে অন-ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে সাথিরা জাকির জেসির খেলা পরিচালনা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। বিতর্কের কারণ তিনি একজন নারী। অবশ্য এ কথা ঠিক, পুরুষদের ক্রিকেটে একজন নারীর আম্পায়ারিং করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৈপ্লবিক বললে অত্যুক্তি হবে না। যে কোনো পরিবর্তনের একটা ঝড়ঝাপটা তো থাকেই। যুগের পর যুগ চলে আসা প্রচলিত সিস্টেমকে যখন ধাক্কা দেওয়া হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে তা অনুরণন তুলতেই পারে। নতুনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গেলে সংঘাত সৃষ্টি হবেই। সংঘাতের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে সমাজ-সভ্যতা৷ বরাবরই এমন হয়ে এসেছে, এ নতুন কিছু নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে নতুনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দেখা যায় কিংবা মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ মানসিকভাবে মেনে না নিলেও আধুনিকতার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন না। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে এর সত্যতা অনায়াসেই বুঝতে পারা যাবে। তা না হলে স্থবির হয়ে যেত সমাজ-সভ্যতা। তবে যে ঘটনা আমরা দূর থেকে অবলোকন করি, সেটা যতটা সহজে ধারণ করা যায়, বাস্তবে যখন সে ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়, তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আম্পায়ার হিসেবে হঠাৎ জেসিকে দেখে মোহামেডান এবং প্রাইম ব্যাংকের অনভ্যস্ত ক্রিকেটার ও সংগঠকরা হতবুদ্ধি এবং সে কারণে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই পারেন। এটা হয়তো তাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। ম্যাচে রীতি ভেঙে নারী আম্পায়ার দেওয়ায় দুই দলই অখুশি হয়েছে। তাদের এমনতর মনোভাবের কারণে খেলা শুরু হতে বিলম্ব হয়। তবে যে কারণেই হোক, এ নিয়ে জল বেশি ঘোলা হয়নি। বিসিবির আম্পায়ার কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ মিঠু বলেছেন, ‘নারী আম্পায়ার নিয়ে দুই দলই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে অভিযোগ করেনি’। মিঠুর এ বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-এ রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মজার বিষয়, নারী হয়েও এ বিষয়ে জেসির অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়ার হার নেহাত মন্দ নয়। তার মানে এই নয় যে, পুরুষদের খেলায় একজন নারীর আম্পায়ারিং করাটাকে হৃষ্ট চিত্তে মেনে নিয়েছেন রক্ষণশীলরা।
তবে মিঠুর মন্তব্য নিয়ে দুই দলই ভিন্ন মত পোষণ করলেও নারী আম্পায়ার নিয়ে আপত্তি ছিল উভয় দলেরই। এটা দুই দলের কর্তাদের কথায় তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। মোহামেডানের ক্রিকেট সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম টিটু ধরি মাছ না ছুঁই পানি কৌশল অবলম্বন করে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘আমরা আসলে আপত্তি তুলিনি। এমনিতে বলাবলি করছিলাম, ম্যাচের মেরিট অনুযায়ী তো এত বড় ম্যাচে জেসি আম্পায়ার হতে পারেন না। আরো ভালো আম্পায়ার দরকার ছিল। আমরা অফিসিয়ালি অভিযোগ করিনি, অফিসিয়ালি অভিযোগ করব কেন। আমরা ওরকমভাবে রিপোর্ট করিনি।’ প্রাইম ব্যাংক দলের ম্যানেজার শিকদার আবুল হাশেম বলেন, ‘মহিলা আম্পায়ার দেবে, এটা তো আমরা জানতাম না। বাংলাদেশে মহিলা আম্পায়ারের অভিজ্ঞতা কেমন, এটা তো আমরা সবাই জানি। আপত্তি করি না। যেহেতু এটা বড় ম্যাচ, এখানে নিয়মিত যারা করে তাঁদের আশা করছিলাম। মহিলা আম্পায়ার যেটা এলবিডব্লিউ সেটা দেননি, যেটা হয়নি সেটা দিয়েছেন।’
হাশেমের কথায় মহিলা আম্পায়ার নিয়ে তার নেতিবাচক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার কথায় মনে হতে পারে, পুরুষ আম্পায়াররা কখনো ভুল সিদ্ধান্ত দেন না। যুক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে তিনি অযৌক্তিক মন্তব্যই করেছেন। এতে তার প্রকৃত মনোভাব বুঝতে বেগ পেতে হয় না। আদতে নারী আম্পায়ার নিয়ে দুই দলের আপত্তি ছিল না, এ কথা বলা যাবে না। তাদের আকার-ইঙ্গিত ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এই সমাজের বাসিন্দা হিসেবে আমরা পরস্পরকে কম-বেশি জানি। কার মনোভাব কেমন, তা বুঝতে খুব বেশি পন্ডিত না হলেও চলে। আর পৌরুষের মহিমা কি, তা তো আর অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা ঝেড়ে কাশতে পারেননি। বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠলে তারা নিজেদের খানিকটা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আনুকূল্য পেলে হয়তো বীরত্ব প্রদর্শন করতে পারতেন। অবশ্য এজন্য তাদেরকে অভিযুক্ত করা যাবে না। যে সমাজ কাঠামোয় আর যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা বেড়ে উঠেছেন, সেখানে নারীকে পুরুষের মতো ভূমিকায় দেখলে সহজে মেনে নিতে পারেন না। তাদের অহমিকা কিংবা অনুভূতিতে হয়তো আঘাত লাগে। এ ধরনের প্রবৃত্তি বেশিরভাগ পুরুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অনেক ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যেও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। অবশ্য সবাই যে একই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তেমনটা বলার সুযোগ নেই। কোনো কোনো সিনিয়র ক্রিকেটার জেসিকে অভিনন্দন ও তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
নারীদের চলার পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তাদের অধিকার ও মর্যাদা আদায় করে নিতে কত লড়াই ও সংগ্রাম করতে হয়। নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলেও তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গি আর কদর্য সমালোচনা থেকে পরিত্রাণ মেলে না। যে সব নারী ইতিহাস গড়েছেন কিংবা সমাজের উচ্চাসনে স্থান করে নিয়েছেন, তাদের জীবন কাহিনি থেকে তা জানা যায়। সাথিরা জাকির জেসিও নারী আম্পায়ার হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী আম্পায়ার। শৈশব থেকেই তার ক্রিকেটের প্রতি ভালো লাগা ও ভালোবাসা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়া। সেই অভিপ্রায় নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে সমানতালে খেলেছেন। এজন্য তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু তাতে তিনি হতোদ্যম হননি। লালমনিরহাটের সন্তান জেসি ধাপে ধাপে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। ২০১০ সালে চীনের গুয়াংজু এশিয়ান গেমসে রৌপ্য পদকজয়ী বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। ডানহাতি অফব্রেক বোলার হিসেবে পরিচিত এই ক্রিকেটার ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন রংপুর বিভাগের হয়ে। খেলছেন প্রিমিয়ার লিগও। ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবেও অর্জন করেছেন সুখ্যাতি। ইতোমধ্যে ১০টি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন। জুনের ১০ তারিখে ইমার্জিং এশিয়া কাপে আম্পায়ারিং করতে হংকং যাবেন। বাংলাদেশ থেকে প্রথম কোনো নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আম্পায়ারিং করবেন। এটা তাঁর জন্য তো বটেই বাংলাদেশের জন্য বড় একটি অর্জন। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই আম্পায়ারিং করে থাকেন। সব মিলিয়ে আম্পায়ার হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার কমতি নেই। পরিস্থিতি সামাল দিতেও যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন স্মার্ট এই নারী।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রথম নারী হিসেবে অন-ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে জেসিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে মোহামেডান স্পোর্টিং এবং শাইনপুকুর স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে তিনিই ছিলেন প্রথম রিজার্ভ আম্পায়ার। ইফতেখার মিঠু জানান, ‘জেসিকে টি২০ বিশ্বকাপের উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রিমিয়ার লিগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি আইসিসির ডেভেলপমেন্ট আম্পায়ার। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ নারী দলের সিরিজে আম্পায়ার হিসেবে বিভিন্ন দায়িত্বে এবং বাংলাদেশ-ভারত সিরিজেও অন-ফিল্ড আম্পায়ার ছিলেন। কোনো দিক দিয়েই তাকে অনভিজ্ঞ বলা যাবে না’। সবচেয়ে বড় কথা, ম্যাচ পরিচালনার ক্ষেত্রে জেসি বেশ দক্ষতার পরিচয় দেন। টুকটাক ভুল করলেও সেটা তেমন গুরুতর ছিল না। এমন ভুল ঘরোয়া ক্রিকেটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অহরহই হচ্ছে। তার বিপক্ষে মাঠে কোনো ক্রিকেটারকে অভিযোগ করতে দেখা যায়নি। এ ম্যাচের ম্যাচ রেফারি ও বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এ এস এম রকিবুল হাসান সেদিনের আম্পায়ারিং নিয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। তিনি আম্পায়ারিং নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
তারপরও বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অন্যতম পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন জেসির আম্পায়ারিং করার প্রসঙ্গকে উসকে দিয়ে বলেছেন, ‘জেসির অভিজ্ঞতা প্রিমিয়ার লিগের মতো বড় ম্যাচে আম্পায়ারিং করার মতো নয়। বড় খেলায় আমি সবসময় মনে করি, আপনাকে এমন একজন আম্পায়ার দেওয়া উচিত, যার অভিজ্ঞতা আছে। মাঠের চাপটা কিন্তু অনেক বড়। যদিও ইদানিং ঘরোয়া ক্রিকেটে আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচে আগের সেই চাপ নেই। তারপরও বড় দল খেলছে, জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা খেলছেন। আপনাকে এমন একজন আম্পায়ার দিতে হবে, যার প্রতি খেলোয়াড়দের শ্রদ্ধাটা থাকে'। জেসি আম্পায়ার হিসেবে দেশ-বিদেশে সমাদৃত হলেও সুজনের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন তাকে একপ্রকার নিরুৎসাহিত করেন, তা আসলেই হতাশাজনক। যদিও সুজন বলেছেন, ‘জেসি খুব ভালো আম্পায়ার। বাংলাদেশের হয়ে ভবিষ্যতে খুব ভালো করবে’। ভালো আম্পায়ার হয়ে থাকলে প্রিমিয়ার লিগে এখনই আম্পায়ারিং করতে অসুবিধা কোথায়? সুজনের মতো নীতিনির্ধারকদের মনোভাব যদি এমন হয়, তাহলে অন্যদের কাছে এরচেয়ে ভালো কী আশা করা যায়? তবে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে জেসিরা যে পথ গড়ে দিচ্ছেন, তার সুফল পাবেন আগামী দিনের নারীরা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে