Views Bangladesh Logo

এক বিস্মৃত মুক্তিযোদ্ধার গল্প ও বাংলাদেশের অবহেলিত ইতিহাস

Rahman  Mridha

রহমান মৃধা

বুয়েটে পড়ুয়া প্রকৌশলীরা যদি কূটনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করতেন, তবে হয়তো জাতির জন্য ভালো হতো; কিন্তু সেটি না করলেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আজ সেই দায়িত্ব বিশ্বমঞ্চে পালন করে দেখাচ্ছেন। তার ভূমিকা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনা ও বিশ্লেষণ। এতে আমার মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে- শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই কি সব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সহজ হয়? নিশ্চয়ই নয়। কারণ জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি এর প্রয়োগ ও চর্চা না থাকলে, সেই বিদ্যাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে চলুন ফিরে যাই এক সময়ের এক মুক্তিযুদ্ধের বার্তাবাহকের জীবনে।

আমি তখন খুবই ছোট; কিন্তু আজও মনে পড়ে সেই প্রথম দেখার স্মৃতি, সেই হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত। শ্যামলা বর্ণের এক হালকা-পাতলা তরুণী, বাঙালির আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ফরিদপুর ছেড়ে এসেছিলেন আমাদের গ্রামে- স্বামীর হাত ধরে, সঙ্গে ফুটফুটে ছোট্ট একটি কন্যা।

তিনি সম্পর্কে আমার দাদি হলেও, বয়সে তরুণী ছিলেন বলে “দাদি” সম্বোধনটি পছন্দ করতেন না। আমি তখন ছোট, অত কিছু বুঝতাম না। একবার দাদিকে বলেছিলাম, “ও দাদি, তুমি কি বাঙালি?”

তিনি তৎক্ষণাৎ কড়া স্বরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, আমি বাঙালি! আর তোরা সব পাঞ্জাবি!”

আমাদের প্রতিবেশী দাদা ছিলেন দরিদ্র, দিনমজুরের কাজ করতেন। দাদি তার মেয়েকে নিয়ে আমার মাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। দাদির মেয়ের নাম ছিল হাসি, তাই সবাই তাকে “হাসির মা” বলে ডাকত।

আমার বড় ভাই, অধ্যাপক ড. মান্নান মৃধা, দাদিকে স্মরণ করে বলেছিলেন, “তিনি ছিলেন এক ফ্লাইং বার্ড, এক ফ্রিল্যান্সার, অলস নন, প্রতিবাদী, বার্তাবাহক।” কারণ, এসবই নাকি প্রকৃত বাঙালির বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে ফরিদপুর, যশোর ও কুষ্টিয়ার মানুষের। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুচিত্রা সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ অনেকেই কোনো একসময় চাপে ও তাপে নিজ এলাকা ছেড়ে বিপ্লবমুখর হয়েছেন। তাদের মেধাই তাদের আলোর ফেরিওয়ালা বানিয়েছে, বিশ্বকে উপহার দিয়েছে নতুন দিগন্ত।

আমার স্মৃতিতে যতটুকু উজ্জ্বল আছে, তাতে মনে হয়, দাদি দারিদ্র্য মোচনের জন্য নয়, ভালোবাসার টানে ফরিদপুর ছেড়ে নবগঙ্গা নদীর তীরে মাগুরার নহাটা গ্রামে এসেছিলেন। তিনি শুধু একটি পরিবারে আসেননি, বাঙালির চেতনা, প্রতিবাদী মনোভাব এবং সংগ্রামী ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি হয়ে এসেছিলেন। সেই প্রথম দেখাতেই যখন বলেছিলেন “তোরা পাঞ্জাবি!”, তখনই বুঝিয়েছিলেন তার বার্তাবাহক ভূমিকার গুরুত্ব।

আজ স্মৃতির জানালা খুলে তাকালে দেখতে পাই- বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিল, সেই ‘পাঞ্জাবি’ শব্দটিকে মুছে ফেলতে। মুক্তিযুদ্ধে দাদির অবদান ছিল অসাধারণ। তিনি মুক্তিবাহিনীর জন্য বার্তা বহন করতেন, রাজাকারদের ঘাঁটিতে গোপনে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন, এলাকার সর্বশেষ খবর সবার আগে প্রচার করতেন। দাদির কাছে গেলেই যেন পাওয়া যেত যুদ্ধের তাজা সংবাদ। অথচ তার কোনো পুঁথিগত বিদ্যা ছিল না, ছিল কেবল বাস্তব জ্ঞান, বিচক্ষণতা আর কৌশলী কূটনীতি।

দাদি আজও বেঁচে আছেন ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে। কঠিন সময়েও তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে, আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের অতীত- আমরা কে ছিলাম, আর কী হয়েছি!

আমাদের দাদি ছিলেন অতি সাধারণ একজন মানুষ। তার জীবনের ছোটখাটো ঘটনাগুলো আমি মোটামুটি জানি, তবে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর সম্পর্ক কিছুটা শিথিল হয়ে গেছে। শেষবার ২০১৪ সালে নহাটায় গিয়ে দুই দিন তার সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। অনেক সুখ-দুঃখের গল্প করেছিলেন; কিন্তু তখন কেন যেন জিজ্ঞেস করিনি- দেশ স্বাধীন হলো, কেউ পেল, কেউ হারাল; কিন্তু দাদি কেন সব চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলেন?

১৯৭১ সালের যুদ্ধে দাদি হারালেন তার বাড়ি, ১২-১৩ বছরের মেয়ে হাসিকে এবং পরে তার স্বামীকে- পাঞ্জাবিদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে। তিনি শুধু হারিয়েছেন; কিন্তু দেশ বা সমাজ তাকে কিছু দেয়নি। কেন?

আজ হঠাৎ দাদির ছোট্ট একটি ভিডিও দেখে মনে হলো, দারিদ্র্যের চরম সীমায় আছেন তিনি। কোনোমতে দু-এক বেলা খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটান। নহাটা বাজারে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সাধ্য নেই তার। হয়তো চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে না; কিন্তু তাকে অবহেলা করাও তো অন্যায়!

আমি মনেপ্রাণে চাই, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে আমরা সবাই যেন এই জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী বাঙালি দাদির জন্য কিছু করি। যদি বাংলাদেশে আবারও একটি পয়লা বৈশাখ আসে, সেই উৎসবে যেন দাদিকেও দেখতে পাই। যেন শুনতে পাই, দাদি বলছেন-

“মেলায় গিয়েছিলাম, দেখলাম এক ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে। কী দারুণ! বাঁশি যে ডাকাতিয়া হয়, এর আগে বিশ্বাস করিনি!”

এই শীতেই আমরা যেন দাদিকে ভালোবাসার একটি ছোট্ট সুখের ঘর উপহার দিতে পারি। যেন এবারের বৈশাখে দাদির মুখে নতুন কিছু হাসির কথা শুনতে পাই- যেমন দেশের মানুষ গণতন্ত্রের মাধ্যমে নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছে!

হে বাংলাদেশ! তুমি ৫৩ বছরে যা পারোনি, ড. ইউনূস তা করে দেখিয়েছেন মাত্র কয়েক মাসে। তার কূটনৈতিক দক্ষতা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশের কূটনীতিকরা তার কাছ থেকে কিছু শিখবে কি না, জানি না। তবে আমি আশা করি, তারা অন্তত এটুকু বুঝবে- একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সৎ ও দক্ষ নেতৃত্ব কতটা জরুরি।

হে প্রিয় জন্মভূমি, আজও তোমাকে প্রতিক্ষণে মনে পড়ে। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, তবু মনে হয়, কী যেন নেই!

তোমাকে কাছে না পাওয়ার এই শূন্যতা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বিধাতার কাছে আমার একটাই চাওয়া

জীবনের শেষবেলায় যেন দেখতে পাই, তুমি সত্যিকার সোনার বাংলা হয়েছো- যেখানে আর কোনো হাসির মা দাদি পরের দুয়ারে হাত না পাতে, শুধু একটু অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা আর বাসস্থানের জন্য!

রহমান মৃধা: গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ