মে দিবসে জোরালো হোক কর্মসংস্থানের দাবি
শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতে সভ্যতা এগিয়েছে। শ্রম দিলেই শ্রমিক- এটা যেমন ঠিক, আবার শ্রমিক বলতে প্রথমে শিল্প শ্রমিকের ধারণা চলে আসে; কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের বিস্তৃতি আরও অনেক ব্যাপক। কেননা পৃথিবীর সব মানুষই কোনো না কোনো কাজ করে আর যে কোনো কাজ করতে গেলেই প্রয়োজন হয় শ্রমের। এই নিরিখে পৃথিবীর সব মানুষকেই শ্রমিক বলা যায়। আবার মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শ্রমিক শ্রেণি হলো সবচেয়ে আধুনিক এমন এক শ্রেণি, যারা সমাজবিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে। কার্ল মার্কস কারখানার শ্রমিকদের বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন। কেননা তারা শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন শ্রমিকশ্রেণি হিসেবে দাস ব্যবস্থার বিপরীতে উঠে এলেও তারা কারখানার এক ছাদের তলায়, একই স্বার্থে একটি সংঘটিত শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
আর তাদের হারানোর কিছু নেই। তারা সর্বহারা। জমি থেকে উৎখাত হওয়া, জনমজুর বা ভূমিহীন কৃষক যখন শ্রমিকে পরিণত হয়, তখন তাদের শ্রমশক্তি ছাড়া উপার্জনের আর কোনো উপায় নেই। তাই, তাদের হারানোর কিছু নেই। শ্রমজীবী বলতে কায়িকশ্রম এবং মস্তিষ্কের শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম। উভয় শ্রমের বিনিময়ে জীবনধারণ যারা করে তারাই শ্রমজীবী। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত যে কোনো ব্যক্তি, সে কৃষি বা শিল্প যে ক্ষেত্রই হোক না কেন, তিনিই শ্রমিক। মানুষের শ্রম ও চেতনা- এই দুই হলো সব সামাজিক সম্পদের উৎস। পেশি ও মস্তিষ্কের শ্রম একত্রে যুক্ত হয়েই সৃষ্টি হয় সভ্যতার যাবতীয় সমাহার। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের হাতে সভ্যতার যাবতীয় সৃষ্টি সাধিত হলেও আধুনিক পুঁজিবাদী সভ্যতা সেই শ্রমজীবী মানুষকেই পদানত করে রেখেছে।
ইতিহাসে অর্ধ-শতাব্দী কালের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল একটি বড় ধরনের বিপ্লব, যা হলো শিল্পবিপ্লব। আঠারো শতকের মধ্যভাগে এই শিল্পবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটি শ্রমিক শ্রেণি গড়ে ওঠে। কুটির শিল্প এবং ছোট ছোট শিল্পকারখানার জায়গায় বসলো মাঝারি ও ভারী শিল্প কারখানা। শিল্প পুঁজির দানবীয় বিকাশ বিবেচনাহীনভাবে শ্রমিকের শ্রমশক্তিকে গ্রাস করে চলল। শ্রমিকদের বাঁচার মতো ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হলো। ক্রীতদাসদের সঙ্গে যে রকম নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো, শ্রমিকের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজ করতে হতো শ্রমিকদের।
১৮৬৬ সালে শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মসময়ের প্রথম দাবি ওঠে আমেরিকার বাল্টিমোর শহরে। ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। হে মার্কেটে ধর্মঘট করা শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ছয় শ্রমিক। এর প্রতিবাদে ৪ মে হাজার হাজার শ্রমিক ফেটে পড়েছিলেন বিক্ষোভে। সে দিনও পুলিশের গুলিতে ৫ জন শ্রমিক মারা যান। আন্দোলন গড়ে তোলার অপরাধে কয়েক জন শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। বিক্ষোভে মৃতপ্রায় এক কিশোর তার রক্তে সিক্ত জামা খুলে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল, যা আজও লাল পতাকা হিসাবে পরিচিত। সে দিন শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার ফলাফল হয়ে উঠলো ভয়ংকর। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে অসন্তোষ। অন্য দেশের শ্রমিকেরাও একাত্মতা প্রকাশ করে সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দেন।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যথার্থই লিখেছিলেন- ‘লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে/কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকার?’ যখন পরিস্থিতি আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন সরকারসহ ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে রাজি হয়। পৃথিবীর বুকে নতুন এক ইতিহাসের জন্ম হয়। শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে থাকেন। শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কর্মসময়ের দাবি এখন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদেও এটি অনুমোদিত। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সব শ্রমিক শ্রেণির কাছে মে দিবস হলো নতুন সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার শপথের দিন। এ দিন দীর্ঘ দিনের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল।
প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে শ্রমজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব শ্রমজীবী মানুষের হাতে আছে? না, নেই। ফলে, কত অসহায় শ্রমিক শোষক সমাজের নিষ্ঠুর পীড়নে নিঃশেষিত হচ্ছে। আরও চিন্তার বিষয় হলো, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ শ্রমজীবী মানুষ, যাদের বেশির ভাগই আজও অধিকার বঞ্চিত। শ্রমিকরাই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মালিকের জন্য খাদ্য-বস্ত্র উৎপাদন করেন, বাসস্থান নির্মাণ করেন। অথচ, এই শ্রেণির লোকদের কঠোর শারীরিক শ্রম ছাড়া নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশেই শ্রমিকদের অধিকার-সংক্রান্ত আইএলও-এর সনদ আজও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যেসব দেশে কার্যকর হয়েছে, সেসব দেশে প্রায়শই তা লঙ্ঘিত হতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও শ্রমিকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে উপেক্ষিত। দেশের প্রচলিত আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও অনেক শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়। এখনো শ্রমিক শ্রেণি সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। অথচ, কাজ কাজই, তা যে প্রকৃতিরই হোক না কেন। মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও দৈহিক কাজের মধ্যে পার্থক্য করা সভ্যতার পরিপন্থি। দরকার শ্রম ও শ্রমিকদের মর্যাদা নিশ্চিত করা।
দুই.
মে দিবস বার বার ফিরে আসে- আর মনে করিয়ে দেয় আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি! যেমন, দিনটি মনে করিয়ে দিচ্ছে অর্থনীতির এক ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। একদিকে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকার কাজের আশায় দিন গুনছে আর অন্য দিকে, সাম্প্রতিক সময়ে সংকুচিত হচ্ছে দেশের কর্মসংস্থান। জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল কর্মসংস্থানের অভাব। শেখ হাসিনার শাসনামলে বৈষম্যমূলক নীতি বেকারত্ব পরিস্থিতিকে খারাপ করেছিল। মূলত চাকরি পাওয়া নিয়ে হতাশা থেকেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এই আন্দোলন গড়ে তোলেন। একটি জরিপে উঠে এসেছে, ৭৮ শতাংশ তরুণ কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। বিগত সরকারের সময়ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল ছিল; কিন্তু গত আট মাসে অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি সিপিডি বলেছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা।
অনেকেই আছেন, যাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বেশিদিন নেই। আয়-রোজগারের পথ বন্ধ থাকলে সমাজে যে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। অন্যদিকে প্রথম আলোর একটি তারুণ্য জরিপে জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিয়ে তাদের বেশি উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণরাই এসব নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় থাকেন। এই উদ্বেগের পেছনে কারণ হচ্ছে, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা। সম্প্রতি দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুটা ব্যাহত হলেও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি খারাপ নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় মানুষের আয়ে প্রভাব পড়েছে। তিনি বলছেন, একই সঙ্গে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কমে গেছে। অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প কমে যাওয়া এর কারণ; এ নিয়ে একনেক বৈঠকের আলোচনা হয়েছে। তবে সরকার ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে এসএমই খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে। তবে মানুষের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তিনি। সে জন্য নতুন কর্মসংস্থান দরকার বলে মন্তব্য করেন।
গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে ৪০ লাখ কোটি টাকা। একই সময়ে দেশে নতুন করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে ছোট-বড় মাত্র ৪০ লাখ ৫৮ হাজার খানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সেবা খাতে ৩৯ লাখ ১৯ হাজার এবং ম্যানুফ্যাকচারিং (উৎপাদন) খাতে যুক্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৫টি প্রতিষ্ঠান। গত ১০ বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৬২ লাখ মানুষের। অথচ ২০১৩ সালে বেড়েছিল দ্বিগুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাক-প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিগত সময়ে জিডিপির আকার যে হারে বেড়েছে, সেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র বাড়েনি। এ কারণে প্রত্যাশা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি, বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছেই। গত ১০ বছরে সাড়ে ৬২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও ২০২৪ সালেই বেকার হয়েছে ৬২ লাখ মানুষ। টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে এই অবস্থার উন্নতি করতে হবে।
এর আগে আমরা দেখেছি, চোখধাঁধানো প্রবৃদ্ধির আসক্তিতে বিগত সরকারগুলো কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কোনো প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধির সূচকসংখ্যা পূরণে সরকারের যে প্রচেষ্টা, তা নিছক ব্যর্থতাকে আড়ালের কৌশলমাত্র। জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক। কিন্তু অগ্রগতির সেটাই একমাত্র সূচক নয়। বাংলাদেশ যদি প্রকৃত অর্থে এগোতে চায়, তাহলে সব ধরনের সম্পদের বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টন করতে হবে; স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার বিধান করতে হবে। আর সামাজিক সুরক্ষার প্রধানতম শর্ত হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে নিম্ন, মধ্যবিত্ত ও সমাজের দরিদ্র ও প্রতিবন্ধীসহ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সামনে জীবন-জীবিকার সংকট রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জোরালো ভূমিকা না থাকায় এ মুহূর্তে বৃহত্তর তরুণ ও যুব জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি অন্যতম একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ কথা আমাদের বিশেষ বিবেচনায় রাখা দরকার, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসে না।
বিবিএস বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাক-প্রতিবেদনে জানা যায়, গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে ৪০ লাখ কোটি টাকা। একই সময়ে দেশে নতুন করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে ছোট-বড় মাত্র ৪০ লাখ ৫৮ হাজার খানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সেবা খাতে ৩৯ লাখ ১৯ হাজার এবং ম্যানুফ্যাকচারিং (উৎপাদন) খাতে যুক্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৫টি প্রতিষ্ঠান। গত ১০ বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৬২ লাখ মানুষের। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিগত সময়ে জিডিপির আকার যে হারে বেড়েছে, সেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র বাড়েনি। এ কারণে প্রত্যাশা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি, বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছেই। গত ১০ বছরে সাড়ে ৬২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও ২০২৪ সালেই বেকার হয়েছে ৬২ লাখ মানুষ। টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে এই অবস্থার উন্নতি করতে হবে।
প্রতি বছর দেশে সব মিলিয়ে ২৪ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। এর মধ্যে ৫ থেকে ১০ লাখ দেশের বাইরে যান, যাদের অধিকাংশই অদক্ষ। দেশে বাকিদের সবার চাকরি হয় না। সে জন্য বিদেশে প্রশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তাতে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। আমাদের অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা থাকা দরকার, যার মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে এবং শিল্পাঞ্চলগুলোর বিকেন্দ্রীকরণও সম্ভব হবে। উদ্ভাবনী আইডিয়া, ব্যবসা উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করার মনোভাব তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে; তাদের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রণোদনা ও দক্ষতা বৃদ্ধি প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোর বাস্তব অবস্থা জানার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ডেটা সংগ্রহ করা দরকার। জাতীয় বাজেটে ব্যাপক হারে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। কারিগরি, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য দরকার ক্যারিয়ার গাইডেন্স এবং একাডেমিয়ার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয়। এ কথা এড়ানোর সুযোগ নেই যে আমরা একটা সংকটকাল অতিক্রম করছি, তবে সরকারের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষতা ও দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করবে বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণের গতিপ্রকৃতি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে সর্বনিম্ন মজুরি বাস্তবায়ন জরুরি। একই সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে দেশের বিদ্যমান বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ‘পণ্য তখনই ভালো হয়, যখন প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে পরিচালিত হয়। এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, বাকস্বাধীনতা ও জলবায়ু বিষয়গুলোতে আরও কার্যকর নীতি গ্রহণ করা জরুরি।’ এই সব তথ্য একটি দিককেই নির্দেশ করছে। কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি শুধু মুখের কথা। এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। এক দিকে, কর্মসংস্থানের এই করুণ দশা, অন্য দিকে, দিনের পর দিন সমাজে আয়ের বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এ ছাড়া, সাম্প্রতিক ছবিও আশাব্যঞ্জক নয়। বর্তমান সময়কালের মধ্যে নতুন কোনো বৃহৎ শিল্পের দেখা মেলেনি। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মহীনতার কারণে শিক্ষিত সমাজও হতাশাগ্রস্ত। তাই এই ‘মে দিবসে’ কাজের দাবিটিকেই আরও জোরালো করে তুলতে হবে। ‘মে দিবস’ এই পরিপ্রেক্ষিতে তাই আরও প্রাসঙ্গিক, আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া, শ্রমিকদের এক জোট হয়ে শ্রমিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা চাওয়ার সময় এখন। তাদের শ্রমকে যেন আমরা সহজলভ্য ভেবে না নেই।
হাবীব ইমন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক। প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে