শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পক্ষান্তরে রাজস্ব বাড়াবে
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে সর্বস্তরে তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার জনগণের স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের দেশেই প্রতিদিন গড়ে ৪৪২ জন তামাকজাত পণ্যের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ব্যবহারের ফলে প্রাণ হারাচ্ছে। এ ছাড়াও অসংখ্য মানুষ হৃদরোগ, ক্যান্সার, ফুসফুসজনিত রোগের মতো বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, যা স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট রোগগুলোর চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতার ক্ষতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়াতে বিদ্যমান ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩)’ এখনই ডব্লিউএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আলোকে সংশোধন করা একান্ত প্রয়োজন। এই আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো পাস হলে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতাগুলো দূর হবে এবং বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি বৈশ্বিক মানদণ্ডে উপনীত হবে।
বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত খসড়ায় যে বিষয়গুলো প্রস্তাব করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অধূমপায়ীদের সুরক্ষার জন্য সব পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা, তামাক পণ্যের প্রচার বন্ধ করার জন্য বিক্রয়কেন্দ্রে তামাক পণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট বা ইমার্জিং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট আমদানি, উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা, তামাক পণ্যের সব ধরনের খুচরা ও খোলা বিক্রয় বন্ধ করা ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা।
কিন্তু জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যেখানে এই সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত পাস করা জরুরি সেখানে তামাক কোম্পানিগুলোর নানান রকম মিথ্যাচার এটিকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী হলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে বলে তামাক কোম্পানি প্রচারণা চালাচ্ছে, যা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০০৫ সালে যখন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়, সে বছর তামাক থেকে রাজস্ব ছিল ২ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। পরবর্তী অর্থবছর ২০০৫-০৬ এ রাজস্ব আদায় হয় ৩ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে যখন আইনটি সংশোধন করা হয়, সেই বছর তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ১০ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা।
বরং কোম্পানিগুলো বছরে যে পরিমাণ রাজস্ব দেয় তামাকজনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তার চেয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়। এমন বাস্তবতাকে এড়িয়ে তামাক কোম্পানিগুলো শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
শুধু তাই নয়, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে নানারকম গুজব ছড়াচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। তাদের দাবি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এটি বাস্তবতার নিরিখে অযৌক্তিক। কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা শুধু সিগারেট বিক্রি করা ছাড়াও নানান রকম পণ্য বিক্রি করেন। তাই একটি পণ্যের বিক্রি বন্ধ হলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দেশে ক্ষতিকর এই পণ্যের ব্যবহারের হার কমবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হলে দেশে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তামাক কোম্পানিগুলো মিথ্যাচার চালাচ্ছে। অথচ এনবিআরের তথ্য অনুসারে দেশে বিড়ি কোম্পানিতে শ্রমিক নিয়োজিত আছে মাত্র ৪৬ হাজার। আর দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে দুই বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটিবি ও জেটিআই। তামাক কোম্পানির প্রতিবেদন অনুসারে তাদের কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৭৬৯ জন (বিএটিবির ১ হাজার ৬৬৯ জন এবং জেটিআইর প্রায় ১০০ জন)। অতএব, সিগারেট কোম্পানিগুলো ৭০ লাখ লোক কাজ হারাবে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ ছাড়াও শিশু-কিশোরদের ধূমপানের নেশায় আকৃষ্ট করতে তারা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে, বিক্রয় স্থলের সামনে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, দেশে ভেপিং ও ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়াতে নানারকম প্রচার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে তামাক কোম্পানিগুলো প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে তরুণ সমাজকে ফেলে দিচ্ছে এক অন্ধকারাচ্ছন্নে। তাই তরুণ প্রজন্মকে তামাকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে সংশোধীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত পাস করা প্রয়োজন।
একই সঙ্গে তামাক কোম্পানিগুলোর সব ধরনের কূটকৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই। তামাক কোম্পানির প্রচারণার এই কূটকৌশল বন্ধে, দেশে রাজস্ব হার বৃদ্ধিতে এবং তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার জোর দাবি জানাই।
মারিয়া সালাম: নিউজ এডিটর, ভিউজ বাংলাদেশ এবং সদস্য তামাকবিরোধী মায়েদের ফোরাম।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে