পরিবেশ সাংবাদিকতা
প্রতিবন্ধকতা রোধে সরকারের জোরালো সমর্থন প্রয়োজন
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পরিবেশের সুরক্ষা বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রয়োজন। আমরা যদি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারি, সেটা হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতী। আমরা যেহেতু জাতি হিসেবে খুব বেশি সচেতন নই, তুচ্ছ স্বার্থেই মহত্তর স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারি। সেহেতু পরিবেশ সুরক্ষায় আমরা কেবল অবহেলাই প্রকাশ করছি না, চরম নৈরাজ্য ও অজ্ঞতাও প্রদর্শন করছি।
গত শনিবার (৪ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৪’ উপলক্ষে ‘গ্রহের জন্য গণমাধ্যম: পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় সাংবাদিকতা’ আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, দেশে পরিবেশ সাংবাদিকতায় অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। পরিবেশ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে এক সাংবাদিকের নামে ১৩টি মামলার নজিরও আছে। অনেককে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে।
বিশ্বজুড়েই পরিবেশ সাংবাদিকদের ওপর হামলা বাড়ছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৫টি দেশের ৪৪ জন পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিক এসব হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন; আর প্রাণঘাতী হামলা থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন ২৪ জন। এসব হামলা ও হয়রানির সবই এসেছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ, সেনাবাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা ও চাকরিজীবী, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের লোকজন এসব হামলা ও হয়রানির জন্য দায়ী।’
আমাদের দেশেও এই একই চিত্র। সেদিকে ইঙ্গিত করেই সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম সেদিনের সভায় বলেছেন, ‘আমি আজ পরিবেশ সাংবাদিকতা করলে অনেকেই আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে; অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যাবে।’ এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ক্ষমতাধরদের হাতে এ দেশের নদী, বন, পাহাড় সবই ধ্বংস হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি কারও নেই। তারা অনেকে রাজনৈতিক ছায়ায় পুষ্ট। তাদের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করতে গেলেও তারা সাংবাদিকদের হুমকি দেন।
পরিবেশ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে বিশ্বের সব ক্ষমতাধরই আজ এক জোট। এর কারণ, ক্ষমতার উৎস পুঁজি। পরিবেশ-প্রকৃতিতে ধ্বংস করেই পুঁজির বিকাশ হয়েছে। পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখতে একদিকে যেমন যুদ্ধ-হানাহানি, রক্তপাত দরকার, আরেকদিকে দরকার পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস। পুঁজিবাদ সমস্ত পৃথিবীকেই এখন শুষে খাচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ যে বিকৃত পুঁজিবাদ তা আজ একবাক্যে সবাই স্বীকার করছেন; কিন্তু পুঁজির দৌরাত্ম্য থেকে আমাদের রেহাই নেই।
পুঁজির বিকার থেকে যদি আমরা বাঁচতে না পারি, তাহলে পরিবেশ বিপর্যয় থেকেও বাঁচব না। এ সম্পর্কে এখনই সচেতন হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই। আর জনমনে এই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটিই করে সংবাদপত্র। জীবনবাজি রেখে একজন সাংবাদিক আসলে গণমানুষকে বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম করেন। সেই সাংবাদিকের জীবন আজ বিপণ্ন কিছু অসাধু ক্ষমতাধরের হাতে। পরিবেশ সাংবাদিকের জীবন বিপণ্ন হলে যে গণমানুষের জীবন বিপণ্ন হবে, বহু প্রাণ-প্রজাতির জীবন বিপণ্ন হবে, সে কথা বলতে আর অপেক্ষা রাখে না।
দেশে পরিবেশ সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা রোধে সবচেয়ে বড় করণীয় সরকারের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন। সম্পাদক পরিষদও এমনটা জানিয়েছে, পরিবেশ সাংবাদিকতায় সরকারের জোরালো সমর্থন পাওয়া গেলে দেশের উন্নয়নে সহায়ক শক্তি হিসেবে গণমাধ্যমের ব্যাপক ভূমিকা রাখা সম্ভব। আশা করি, সরকারের এই বোধদয় হবে, যে কোনো মূল্যে পরিবেশ সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে