তিস্তার পানি বণ্টনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে নজিরবিহীন এক আন্দোলন দেখাল বাংলাদেশের জনগণ। দুই দিনব্যাপী ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন লাখো মানুষ। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচিতে কৃষক, জেলে, মাঝি, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। গান, পথনাটক ও কবিতার মাধ্যমে তিস্তাপাড়ের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়।
গতকাল তিস্তা নদীবেষ্টিত পাঁচটি জেলার ১১টি স্থানে একসঙ্গে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নদীপাড়ের হাজারো বাসিন্দা কর্মসূচিতে অংশ নেন। কর্মসূচিতে যোগ দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও। এ সময় আন্দোলনকারীরা বলেন, ভারত বছরের পর বছর তিস্তা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করেছে যার মাশুল দিচ্ছে বাংলাদেশের পাঁচ জেলার অন্তত দুই কোটি মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে এসব এলাকার মানুষ ফসল ফলাতে পারে না। আবার বন্যার সময় হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেয়ায় ব্যাপক এলাকা ভাঙনের শিকার হয়। প্রায় এক ঘণ্টা আন্দোলনকারীরা পানিতে অবস্থান করেন।
গতকাল বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, তিস্তা নদীর পানির অধিকার ফিরে পেতে বাংলাদেশকে জাতিসংঘে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান হবে না। শনিবার রাজধানীতে গোলটেবিল বৈঠকে কয়েকজন পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এ কথা বলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, পানির হিস্যা পেতে জাতিসংঘে জোরালো দাবি জানাতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে আগে তিস্তা সমস্যার সমাধান করবে।
গণপদযাত্রা, বিএনপির নেতৃবৃন্দের বক্তব্য এবং পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য শুনে আমরা অবশ্যই আশাবাদী, যে তিস্তার পানি হিস্যা আদায়ে এবার নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দাবি আদায়ে যতটা হাকডাক হয়, নির্বাচনের পরে অনেক কিছুই ক্ষমতাসীন সরকার ভুলে যায়। তিস্তার পানি হিস্যা নিয়ে এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবয়ন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব লেগে আছে বহু বছর ধরে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এ ব্যাপারে তেমন আশানুরূপ কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। মহাপ্রকল্পের পরিকল্পনা করলেও ভারতের বাধার মুখে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারেরও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নিরুৎসাহ দেখা গেছে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ভারতও যেমন করতে চায়নি, তেমনি বাংলাদেশের পক্ষেও জোরালোভাবে এ দাবি উত্থাপন করা হয়নি।
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, নদী প্রসঙ্গে ভারতের অন্যায্য ভূমিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শক্ত ও সরব অবস্থান গ্রহণ জরুরি। শুধু তিস্তা নয়; ভারত আরও অনেক নদীতে অশুভ দৃষ্টি ফেলেছে। সব আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় ঠিক করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী আছে বলা হয়, অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা অন্তত ১২৩। এগুলো চিহ্নিত করে যৌথ নদী রক্ষা কমিশন থেকে স্বীকৃত হতে হবে। একই সময়ে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিষয়ে আপত্তি জানাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে প্রতিকার চাওয়া ও আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। এতে ভারতের পানিবিষয়ক আগ্রাসন দুনিয়াবাসী জানবে। সামাজিক একটি চাপ সৃষ্টি হবে। বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের পানিশোষক চরিত্র ব্যাপকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।
সাম্প্রতি এই গণপদযাত্রা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভালো সাড়া পড়েছে। এখন প্রয়োজনে জাতিসংঘেও এ নিয়ে দাবি জানাতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়না ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে মহাপরিকল্পনা দেবে। তবে চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তারা একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে সরকারের কাছে। তিস্তা নদীর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে সরকার শক্ত অবস্থানে থেকে আলোচনা চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আমরা আশা করি, তিস্তার পানির হিস্যা আদায়ে বর্তমান সরকার ও ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারও কার্যকর ভূমিকা চালিয়ে যাবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে