Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি হোক নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে

Editorial  Desk

সম্পাদকীয় ডেস্ক

বুধবার, ৩ এপ্রিল ২০২৪

হান দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, রাজনীতি হচ্ছে জোরজবদস্তি ছাড়া তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। সমাজে নানা মুনির নানা মত। মত যেহেতু বহু তা নিয়ে সংঘর্ষও অনিবার্য; কিন্তু, সংঘর্ষকে সহিংসতার দিকে নিলে কেবল সন্ত্রাসই বাড়বে। গণতান্ত্রিক চেতনার প্রাথমিক লক্ষ্যই হচ্ছে যৌক্তিক বিতর্কের মাধ্যমে সমাধানের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে যুক্তির চেয়ে জোরজবদস্তিই প্রধান হয়ে উঠছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গণতান্ত্রিক চেতনা ও রাজনীতির সূতিকাগার। আমাদের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন থেকে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তীতে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন সবই এর প্রমাণ। এসব আন্দোলন-সংগ্রাম প্রথমে জেগে উঠেছে ছাত্রদের মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নির্দিষ্ট করে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই; কিন্তু গত তিন দশক থেকে বিশ্ববিদ্যায়গুলো অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে। ফলে একদিকে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন দেশপ্রেম ভুলে যাচ্ছে, অন্য দিকে নিপীড়িত মানুষের লড়াই থেকেও পিছিয়ে থাকছে।

সাধারণত ছাত্র-ছাত্রীরা এখন অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক। পড়াশোনাটাকে তারা কেবল ক্যারিয়ার গঠনের মাধ্যম হিসেবেই নেয়। দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে যে খুব একটা ভাবে বলা যাবে না। ফলে রাজনীতির নামে যে কোনো প্রকার ‘অরাজকতা’ তারা এড়িয়ে চলতে চায়। শিক্ষার্থীদের অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষও বুঝে না বুঝে ছাত্রছাত্রীদেরই পক্ষ নেন। এতে তাদেরও খুব বেশি দোষ দেয়া যাবে না এই কারণে যে, সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশটাই হয়ে উঠেছে জোরজবদস্তির।

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েট-শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি স্থগিত করা হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসেন। আবরার হত্যার পর সারা দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য জোর আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রশাসন।

এরপর থেকে গত সাড়ে চার বছর প্রকৌশল শিক্ষার এই বিদ্যাপীঠে ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধই ছিল। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ একদল নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বুয়েটে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে নতুন করে রাজনীতি শুরুর পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে, ক্যাম্পাসে পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়া ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন তারা।

এর মধ্যে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর দাবিতে পাল্টা কর্মসূচি দেয় ছাত্রলীগ। রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে তারা অবিলম্বে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালুর অনুমতি দেয়ার দাবি জানায়। পরে বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী। ছাত্রলীগের অভিযোগ, বুয়েট ক্যাম্পাস রাজনীতিহীন, এই সুযোগে সেখানে বাসা বাঁধছে শিবির। বুয়েটে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। এটা তো হতে দেয়া যায় না।

ছাত্ররাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সোমবার হাইকোর্টে রিট মামলা করেন হল থেকে বহিষ্কৃত ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বী। তার আবেদনের শুনানি করেই বুয়েটের নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করার পাশাপাশি রুল জারি করেন বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের বেঞ্চ। রিটের শুনানি শেষে সোমবার (১ এপ্রিল) প্রশাসনের জারি করা সেই বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করেন হাইকোর্ট। পরে আইনজীবীরা জানিয়েছেন এখন থেকে বুয়েটে রাজনীতি চলতে কোনো বাধা নেই।

বুয়েটে যদি ছাত্ররাজনীতি চালু হয়, তাহলে সেটা কোন প্রক্রিয়ায় হবে? কিংবা রাজনীতি চালু করতে কোনো ধরনের বৈঠক করতে হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। এমন প্রশ্নের জবাবে বুয়েট উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কোর্টকে আমরা তো ভায়োলেট করতে পারব না। আমাদের কোর্টের নিয়মে চলতে হবে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সঙ্গে কথা বলব।’ রাজনীতির পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য ছাত্র-শিক্ষক ও প্রশাসন মিলে আলোচনার মাধ্যমে পথ খুঁজে বের করার কথাও জানান বুয়েট উপাচার্য।

এই অবস্থায় ছাত্ররাজনীতি চালু হলে আবার কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে কি না, সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে শিক্ষার্থীদের। বুয়েটে ফের ছাত্ররাজনীতি চালুর বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষ-বিপক্ষে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে সমস্যা থাকতে পারে, তার মানে এই না যে, রাজনীতিই বাদ দিতে হবে। মাথাব্যথার জন্য যেমন আমরা মাথা কেটে ফেলি না। দেশ-জাতি-মানবপ্রেম নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কী করে সুষ্ঠু রাজনীতি করা যায়, সে পথই সবাইকে খুঁজতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ