বন্ধ নয়, ছাত্ররাজনীতিকে শুদ্ধ করতে হবে
গ্রামে একটা কথা আছে, গরিবের বউ সবার ভাউজ। ভাউজ মানে হলো ভাবি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্ররাজনীতি হলো তেমন গরিবের বউ। কিছু ঘটলেই দোষ পড়ে ছাত্ররাজনীতির ঘাড়ে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু ঘটলেই দাবি ওঠে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের। এই প্রবণতা নতুন নয়। অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতারা যখন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়েন; তখনই সবাই শোরগোল তোলেন ছাত্ররাজনীতি বন্ধের; কিন্তু যুবলীগ নেতারা যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত, কেউ কি একবারও যুবরাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন? বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের অনেকেই যে হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত; কেউ কি একবারও রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন, ভুলেও ভেবেছেন। আচ্ছা বাদ দেন রাজনীতি। বাংলাদেশের কোন পেশার মানুষের মধ্যে অবক্ষয় নেই- পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক; কোনো পেশায় বেশি, কোনো পেশায় কম; তাই বলে কি কোনো পেশা বন্ধের দাবি উঠেছে? সব দোষ তাহলে ছাত্ররাজনীতির হবে কেন?
এখন দেশে একটা বিপজ্জনক রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। জিজ্ঞেস করলেই তারা স্মার্টলি জবাব দেয়, ‘আমি রাজনীতি পছন্দ করি না।’ শুধু নতুন প্রজন্মই নয়, সব বয়সের মানুষের মধ্যেই রাজনীতি নিয়ে এক ধরনের অনীহা কাজ করে। সাধারণ মানুষ রাজনীতিকে এক ধরনের ভয় পায়। তাই দূরে থাকে। এখন আর কেউ চান না, তার সন্তান ছাত্ররাজনীতি করুক। আর মন্ত্রী-এমপি-নেতা-আমলারা তো তাদের সন্তানদের বিদেশেই পড়ান। তাই দেশ, রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি গোল্লায় গেলে তাদের যেন কিছু যায়-আসে না। এই প্রবণতা দেশ ও জাতির জন্য বিপজ্জনক। তাহলে কি আমরা নিজেরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকব আর জেনেশুনে দুর্বৃত্তদের হাতে দেশটা লিজ দিয়ে দেব?
ব্যাপারটা যদি এমন হয়, মেধাবীরা সব বিসিএস ক্যাডার হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে বা ভালো চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যাবে; আর যারা ছাত্র হিসেবে খারাপ, স্বভাবে মাস্তান, তারাই শুধু রাজনীতি করবে? তাহলে আমাদের কপালে সত্যি খারাবি আছে। কারণ ব্যাপারটা খুব সহজ, সাধারণ নিয়মে যারা রাজনীতি করবে, তারাই ভবিষ্যতে এমপি হবে, মন্ত্রী হবে; রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করবে।
একটু কল্পনা করুন, ক্লাসের মেধাবী ছাত্রটি বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে গেল আর মাঝারি মানের ছাত্রটি রাজনীতি করলো। যে বিসিএসে গেল সে প্রমোশন পেতে পেতে সচিব হলো। আর মাঝারি ছাত্রটি ধাপে ধাপে মন্ত্রী হলো। এখন মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত কিন্তু মন্ত্রীই নেবেন, সচিব তা কার্যকর করবেন শুধু। তার মানে কম মেধাবীরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, আর বেশি মেধাবীরা তা কার্যকর করছেন। ব্যাপারটা যদি উল্টো হতো যদি মেধাবীরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গায় থাকত, তাহলে তা দেশ ও জাতির জন্য আরও কল্যাণকর হতো। আমি বলছি না, সব ছাত্রকেই রাজনীতি করতে হবে। যার রাজনীতি ভালো লাগে সে রাজনীতি করবে, যে একাডেমিকভাবে ভালো করতে চায়, সে তাই করবে; কিন্তু ছাত্ররাজনীতির বন্ধের নামে রাজনীতি করতে চান, এমন একজন ছাত্রের সামনে একটি অপশন বন্ধ করে দেয়া মানে তো তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। ১৮ বছর বয়সীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তারা ভোট দিতে পারবেন; কিন্তু রাজনীতি করতে পারবেন না, এ কেমন বৈপরীত্য!
আমি নিজে তুমুল রাজনীতিমুখী মানুষ। রাজনীতির একশটা, হাজারটা সমস্যা আছে। তারপরও আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতিই আমাদের শেষ ভরসা। আমরা যত সমালোচনাই করি, রাজনীতিবিদরাই দেশ চালান, নীতিনির্ধারণ করেন। সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অন্য যে কোনো ব্যবস্থার চেয়ে ভালো। এই শিক্ষা আমার জীবন থেকে নেয়া। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ব্যয় করেছি নিজের ছাত্রজীবনের একটা বড় অংশ। তাতে একাডেমিক ক্যারিয়ারের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বটে; কিন্তু এখন পর্যন্ত জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়েছি সেই রাজনীতি থেকেই। নিজের যৌবন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যয় করতে পেরেছি বলে আমি সবসময় গর্ব করি। ব্যক্তিগতভাবে ছাত্ররাজনীতির কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ছাত্ররাজনীতি একজন ছাত্রকে সাহসী করে, দায়িত্বশীল করে, স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে ভাবতে শেখায়। জীবনের সমস্যাগুলো সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে শেখায়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নেতৃত্ব দিতে শেখায়। একজন রাজনৈতিক কর্মী কখনোই তার সহযোদ্ধাকে বিপদে ফেলে পালাবে না। একজন রাজনৈতিক কর্মী কখনোই একা কিছু খাবে না, কেউ কারাগারে গেলে বা পালালে তার পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে হয়েছে। সেখান থেকে সবাইকে নিয়ে নিরাপদে ফিরতে নিতে হয়েছে অনেক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। জীবনকে আমি বড় করে দেখেছি, মোকাবিলা করেছি ছাত্ররাজনীতির সুবাদেই।
মানুষের জীবনটা শুধু হেসে খেলে, বিয়ে করে, ছাও পুষে পার করে দেয়ার জন্য নয়। জীবনের আরও মহত্তর লক্ষ্য আছে। আছে সমাজকে, রাষ্ট্রকে, বিশ্বকে আরও ভালোর পথে বদলে দিতে আপনার জীবনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। এখন রোবটেরও বুদ্ধি আছে; কিন্তু মানুষ রোবট নয়। গাছেরও জীবন আছে; কিন্তু মানুষ গাছ নয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা। কারণ মানুষের জীবন আছে, বুদ্ধি আছে, বিবেক আছে, বিবেচনা আছে। এই পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করতে, আরও উন্নত করতে সে তার আদর্শকে কাজে লাগাবে। ভালোর সঙ্গে মন্দের পার্থক্য করবে। একজন ছাত্রের মধ্যে সেই আদর্শিক চেতনার বীজ বুনে দেবে ছাত্ররাজনীতি।
বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে; কিন্তু ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, তার সময় থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্ররাজনীতির পচন।
এরশাদের আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান ছিল। তখন আমরা জানতাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উত্তরপাড়া ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণপাড়া ছাত্রলীগের। হলে হলে আলাদা ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য ছিল; কিন্তু গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় পা রাখার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে এককেন্দ্রিক। এখন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, ক্যাম্পাসে শুধু তাদের তৎপরতাই থাকে। বাকিরা রীতিমতো নিষিদ্ধ। যেমন এখন ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস। ছাত্রদলের কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন ছিল উল্টো চিত্র। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি বদলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখন ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব। তবে এটা জনপ্রিয়তায় বা ভালোবাসায় নয়; গায়ের জোরে ভয় দেখিয়ে। সমস্যাটা এখানেই। ছাত্রলীগের মাস্তানী, চাঁদাবাজি, দখলবাজিকে আমরা ছাত্ররাজনীতির সমস্যা ভেবে বসে আছি।
১৮ থেকে ২৫ এই বয়সটাই অন্যরকম। এই সময় মানুষ কিছু না কিছু করার জন্য তড়পায়। সবাই তখন ‘আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হবো শান্ত...’ এর মতো বিদ্রোহী; সবাই তখন মিছিলে যাওয়ার জন্য, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। তারুণ্যের সেই শক্তিকে গঠনমূলক কাজে লাগাতে না পারলেই বরং বিপদ। আমরা আগে দেখেছি, যে সব প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নেই, সেখানেই জঙ্গিবাদের চাষবাস হয়েছে।
বুয়েটেও সেই দুঃসময়ের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। অনেকেই বলেন, এখন আর ছাত্ররাজনীতির কোনো লক্ষ্য নেই, তাই এর দরকারও নেই। এটা ঠিক ভাষার দাবি, শিক্ষার দাবি, স্বৈরাচার পতনের দাবি, সমাজ বদলের দাবি- এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই তাদের সামনে। অবশ্য একেবারে কোনো লক্ষ্য নেই তা বলা যাবে না। এই যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেস্টরুম, টর্চার সেল, র্যাগিংয়ের কথা শুনি; সুস্থ ছাত্ররাজনীতি থাকলে কোনোভাবেই এটা সম্ভব হতো না। এখনো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানান সমস্যা আছে। সেই সব সমস্যা সমাধানে ছাত্র নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এ ছাড়া গণতন্ত্রের দাবি, ভোটাধিকারের দাবি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি আদায়েও ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, একে শুদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের পাইপ লাইনটা উন্মুক্ত। আসলে সুস্থতার পাইপ লাইনটা বন্ধ করে আমরা অসুস্থতার আমদানি করেছি অবাধে। আর অসুস্থতার চিকিৎসা না করে, তাকে গলা টিপে হত্যা করতে চাইছি।
লেখক: কলামিস্ট ও হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে