ঢাবিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শিক্ষার্থীদের নথিপত্র, ঝুঁকিতে তথ্য নিরাপত্তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রশাসনিক ভবনের বারান্দা ও করিডোরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও একাডেমিক নথিপত্র। ফলে তথ্য ঝুঁকি ও মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ২০৮ নম্বর কক্ষ ও আশপাশের করিডোরে লাল সুতা দিয়ে বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়েছে হাজারো গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। শিক্ষার্থীদের নাম, রোল নম্বর, পরীক্ষার ফলাফল, ভর্তি ফরম, ট্রান্সক্রিপ্ট এবং অন্যান্য একাডেমিক রেকর্ডগুলো খোলা টেবিল, পুরোনো মরিচায় ধরা আলমারি কিংবা জানালার পাশে খোলামেলা ফেলে রাখায় সহজেই ছবি তোলা বা নকল হওয়ার শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কাগজে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য, যা তথ্য সুরক্ষারও চরম লঙ্ঘন। তাদের মতে, সংরক্ষিত এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, পরীক্ষার নম্বরপত্র, এমনকি ভর্তি-সংক্রান্ত ফটোকপিও। এসব তথ্য চুরি ও প্রতারণামূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পদ্ধতিকে সহজসহ নানা অপরাধে অপব্যবহার করতে পারে অপরাধীরা।
শিক্ষার্থীদেরও আশঙ্কা, তাদের পরিচয় চুরি হয়ে গেলে ব্যাংকিং বা অনলাইন জালিয়াতি, ভুয়া সনদে চাকরি বা উচ্চশিক্ষায় প্রতারণা এবং একাডেমিক রেকর্ড বিকৃতি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে পারেন তারা।
ঢাবির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ফাইলগুলো যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকার কোনো যুক্তি নেই। এটি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক শাখাগুলোর চরম গাফিলতি ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, দুটিই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
রেজিস্ট্রার মুন্সী শামস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিন নতুন নথি জমা পড়ে। তাই পুরোনো ও অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো রাখার জায়গার অভাব হয়। ফলে অনেক সময় করিডোর বা বারান্দায় রাখতে হয়। এগুলো নির্দিষ্ট সময় পর বিক্রি করা হয়। এটিই সরকারি নিয়ম।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাইল বিক্রিতে তথ্য বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনায়ও বারবার বলা হয়েছে, তথ্য ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে নিরাপদ আর্কাইভিংয়ের কথা; কিন্তু বাস্তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, তথ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল ও আধুনিক ডেটা ম্যানেজমেন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার না থাকাও এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
২০২২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ‘সাজিদ উল কবির’ নামে একজন ভুয়া শিক্ষার্থী ধরা পড়েন। তিনি ৩ বছর ধরে অন্যের পরিচয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা দিয়ে আসছিলেন। আইডি কার্ডের দুর্বল ডিজাইন ও সহজপ্রাপ্যতা সেই প্রতারণাকে সম্ভব করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নিয়মিত ভুয়া আইডি ব্যবহার করে টিউশন পেতে চেষ্টারও অভিযোগ রয়েছে।
এসব উদাহরণ তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাবির তথ্য নিরাপত্তা সংস্কৃতি এখনো দুর্বল এবং কাগজভিত্তিক ব্যবস্থায়ই নির্ভরশীল। যেমন- লাইব্রেরি বরোয়ার্স কার্ড চালু হলেও তার ব্যবহার সীমিত এবং সেটিও আইডির বিকল্প হয়ে ওঠেনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে তাদের একাডেমিক জীবন গড়ে তোলে। এ ধরনের গাফিলতি তাদের সেই আস্থার পরিপন্থি। তথ্য সুরক্ষা আইন অনুসারে এটি গুরুতর অপরাধের শামিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে