বিদেশে লেখাপড়া: যেন স্বপ্নের আবরণে মোড়া এক দুঃস্বপ্ন
বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে দেশের বাইরে লেখাপড়া করতে যাওয়া একটি সুখস্বপ্নের মতো। বিভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতি থেকে আসা নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ, নতুন জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা, নতুন নতুন জায়গা ঘোরার সুযোগ এবং ভিন্ন পরিবেশে শিক্ষালাভের সুযোগ- এগুলোর প্রত্যেকটিই বেশিরভাগ তরুণের মধ্যে এক অমোঘ আকর্ষণ সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। তবে সত্যিই কি বিদেশে পড়তে যাওয়া যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে? যদিও এই প্রশ্নের জন্য ঠিক বা ভুল উত্তর বলে কিছু নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে নির্দিষ্ট সেই ব্যক্তি এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার ওপর।
আমি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, এত অল্পবয়সে নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে পড়তে যাওয়া খুব দারুণ কোনও সিদ্ধান্ত। তবে এটিও ঠিক যে এতে চোখের সামনে আসল দুনিয়া দেখার সুযোগ ঘটে এবং দুনিয়ার অন্যপ্রান্তের কায়দাকেতা সম্পর্কে জানা যায়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রামগুলোতে ভর্তি হতে দেশের বাইরে যায়, আর সেখানে সন্তানদের আর্থিক সহায়তা যোগাতে অনেক অভিভাবককে নিজেদের জমিজমা বিক্রি করতে হয়।
আমি তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে কানাডায় এসেছি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটুকু বলতে পারি যে, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি দেশে আসতে হলে অনেক সাহস আর মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন।
অবশ্য বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ আর সংগ্রামের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হলেও, সিদ্ধান্তটি অনেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আর এখানে অন্যতম চ্যালেঞ্জের বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায়, নিজের পরিবারের জন্য মন কেমন করা! আমি জানি এটি শুনতে বেশ ভয়াবহ মনে হচ্ছে এবং নিশ্চয়ই কেউই জীবনের নতুন যাত্রাপথের শুরুতেই এসব শুনতে চাইবে না। তবে আমাদের সবারই নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সৎসাহস থাকা প্রয়োজন। প্রথমবার আমার জন্য বিষয়টি কেমন ছিল এবং এখনও তার প্রভাব কতখানি- সে সম্পর্কে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলব।
উড়োজাহাজে ওঠার পর, দেশের বাইরে নতুন জীবন শুরু করার জন্যে পরিবারকে পেছনে ফেলে আসার কারণে আমার হৃদয়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিলাম। আমি প্লেনের সিটে বসলাম এবং ভবিষ্যতের অজানা যাত্রার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। বারবার মনে পড়ছিল আমার পরিবারের কথা, বিমানবন্দরে আমার মা আর বোন আমার ইমিগ্রেশনে যাওয়ার সময় হলে নিজেদের আর ধরে রাখতে পারেনি। অন্যদিকে, আমার বাবা আমার সামনে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ না করে আমাকে দৃঢ়তার সঙ্গে নতুন যাত্রাপথে চলার সাহস জুগিয়েছেন। সত্যি বলতে বিদায়ের পুরোটা সময়ই আমি শোকে অসাড় হয়ে ছিলাম, কিন্তু বিমান বাংলাদেশের মাটি থেকে ক্রমশ উপরে উঠতে শুরু করলে বুকের ভেতরে অসহনীয় এক কষ্ট অনুভব করতে থাকি। আমি তখন কেবলই আমার প্রিয়জনদের, আমার দেশকে পেছনে ফেলে যাওয়ার দৃশ্য অসহায়ভাবে দেখছিলাম। আর সেই মুহূর্তে এছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না, কেননা আমার পক্ষে জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত আর পরিবর্তন করার কোনও সুযোগ ছিল না।
এরপর যখন আমি সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ অপরিচিত শহরটিতে এসে পৌঁছাই, অদ্ভুত দৃশ্য ও শব্দ আমাকে ভীষণ আবেগতাড়িত করে তোলে। সেই অদ্ভুত জায়গায় নিজেকে আরও বেশি একা মনে হচ্ছিল, কারণ মনে হচ্ছিল যেদিকেই তাকাই আমার বাড়ির ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে।
একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবনধারা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ের পাশাপাশি, আমি প্রায়ই আমার খুব কাছের মানুষদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরার জন্য রীতিমত ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। আমি আমার ছোট্ট ভাড়া ঘরে গভীর রাত অবধি পড়াশোনা করার একটি নিঃসঙ্গ রুটিন তৈরি করেছি। আমার ঘরে শব্দ বলতে যা শোনা যায় সেটি হল- রেকর্ড করা ক্লাস লেকচার। এছাড়া আমি যে শব্দগুলো শুনতে পাই তা হল, ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ, আমার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির শব্দ, এবং মাঝে মাঝে আমি শুধুই নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাই। এত বছর ধরে যে নীরবতার জন্য আমি আকুল ছিলাম, এখানে এসে তা মোটেও খুব শান্তিময় বলে মনে হয়নি। একমাত্র যে শব্দটি আমাকে আনন্দে ভরিয়ে দেয় তা হল আমার বাড়ির মানুষদের কাছ থেকে আসা ভিডিও কল।
আমার আত্মোপলব্ধি হল, এতদিন আমি যে স্বাধীনতার জন্য কাঙাল ছিলাম, এখানে এসে তা পাওয়ার পরও আমার মনে শান্তি আসেনি। আমি প্রতিনিয়ত এক শূন্যতার অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করেছি, যে অনুভূতি আমার নতুন স্বাধীন জীবনে কোনরকম বিধিনিষেধ না থাকার পরেও আছে। যখনই ঘরের বাইরে থাকি তখন আমি বারবার আমার ফোনের দিকে তাকাই এই ভেবে যে এখনই হয়ত আমার মা আমাকে কল দিয়ে বকাঝকা করবে। আমি আশা করতাম যে আমি বাইরে থেকে ফেরার পর আমার বাবা আমার জন্য দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করবে, "কোথায় গিয়েছিলি?" আমি আশা করি যে আমার বোন আমার ঘর থেকে বের হতে চাইবে না, কিন্তু তারপরে আমি বুঝতে পারি যে এখন আমার সম্পূর্ণ নিজের একটি ঘর আছে। আক্ষরিক অর্থে সবকিছু আমাকে আমার পরিবার এবং তাদের রাগমিশ্রিত ভালোবাসার উষ্ণতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে ছোট রান্নাঘরে একা রান্না করা একটি স্মৃতিকাতর রুটিনে পরিণত হয়েছে। সেখানে তেল ছেটার শব্দ আর মশলার সুগন্ধিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও সেসব কোনকিছুই ঘরের রান্নার স্বাদ, পারিবারের সবার সঙ্গে বসে খাওয়ার অনুভূতি এবং সেইসঙ্গে প্রিয়জনদের হাসির জন্য আমার ব্যাকুলতা একটুও কমাতে পারেনি। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার, আমাদের ছোট্ট পারিবারিক উদযাপনের স্মৃতিচারণ আমার ছোট্ট হৃদয়কে ভারী করে তোলে। আমার মা বিরিয়ানি, পোলাও, কোরমা, বিফ কারি, মায়ের স্পেশাল সুইট চিলি চিকেন থেকে শুরু করে পুডিং, কাস্টার্ড ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করত। আমরা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে মায়ের তৈরি সুস্বাদু খাবার উপভোগ করতাম এবং পুরো দিনটি একসঙ্গে কাটাতাম।
দিনগুলো যতই আমাকে অপার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাক না কেন, আমি যে তৃপ্তির স্বপ্ন দেখেছিলাম সবকিছুতেই তার প্রবল অভাব ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি একা যে প্রতিটি ক্ষণ ব্যয় করেছি তা আমার ভেতরের শূন্যতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, আমাকে প্রিয় মানুষদের ভালোবাসার উষ্ণতা আর নিজের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য আকুল করে তুলেছে।
এখানে আসার দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও আমি এখনও এই হাহাকার জাগানীয়া অনুভূতি থেকে মুক্ত হতে পারি না যে, যখন আমি ব্যস্ত রাস্তা ও প্রাণবন্ত শহুরে জীবনের মধ্য দিয়ে হাঁটি তখন আমি একদম একা আমার নিজের জীবনের কেবল একজনমাত্র দর্শক। আকর্ষণীয় রাতের জীবনের উন্মাদনা আর অন্যদের অট্যহাসির শব্দ আমার শূন্য আত্মাকে ছিঁড়ে ফেলা তীক্ষ্ণ তীরের মতো হয়ে ওঠে। উচ্চশিক্ষার সন্ধানে এবং নিজের একটি নাম তৈরি করার জন্য আমি যেখানেই যাই না কেন, আমার মন অহর্নিশ আমাকে পেছনে ফেলে আসা আমার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং ভালবাসার বন্ধনে বেঁধে রাখে, যা সবসময় আমাদেরকে একসঙ্গে আবদ্ধ করে রাখে।
বিদেশে পড়াশোনা করা একটি রোমাঞ্চকর ও জীবন পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা হতে পারে যা বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক উপোলব্ধি ও ব্যক্তিগত বিকাশের সুযোগ করে দেয়। তবুও, এটি নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, হোমসিকনেস মোকাবেলা করা এবং পড়ালেখার চাপ সামলানোর মতো অসুবিধাগুলোর অনন্য দৃষ্টান্তও উপস্থাপন করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে এবং নিজের একটি পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে শিখতে হবে। আর তাতেই এই বাধাগুলো অতিক্রম করার এবং অধ্যবসায় চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরের এই সমস্ত ত্যাগের প্রতিদান মিলবে।
লেখক: কানাডার ব্রক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেবার স্টাডিজ বিভাগে স্নাতকে অধ্যয়নরত এবং টরন্টোর উদ্যোক্তা ক্লাবে প্রশাসনিক সহকারী হিসেবে কর্মরত।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে