২৪৫ বছর আগে আজকের দিনে প্রকাশিত হয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশনার দিনটি আজ। অর্থাৎ আজ থেকে ২৪৫ বছর আগে জেমস অগাস্টাস হিকির সম্পাদনা ও প্রকাশনায় ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘হিকিজ বেঙ্গল গেজেট’। সেদিন ছিল শনিবার। পত্রিকাটির মাস্টহেডের নিচে লেখা ছিল ‘অর দি অরজিনাল ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার’। পত্রিকাটি ভারত উপমহাদেশের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র।
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, ‘বেঙ্গল গেজেট’ আকারে ছিল ১২ ইঞ্চি লম্বা, আট ইঞ্চি চওড়া ও পাতা ছিল দুটি। প্রতি পাতায় ছিল তিনটি কলাম। প্রথমদিকে ছাপা হতো ২০০ কপি। প্রথম সংখ্যাতেই পত্রিকাটি ঘোষণা করে- ‘এটি একটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সাপ্তাহিক, সব দলের জন্য উন্মুক্ত কিন্তু কারও দ্বারা প্রভাবিত নয়।’
বেঙ্গল গেজেট পত্রিকাটির ইতিহাস কিছুটা বৈচিত্র্যপূর্ণ। কারণ এটির প্রতিষ্ঠাতা জেমস অগাস্টাস হিকি কিছুটা জেদ করেই এই পত্রিকাটি প্রকাশ করা শুরু করেন। এটি প্রকাশের আগে তিনি জেলে ছিলেন। তখনকার সময়ে জেলে থাকলে নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হতো। হিকি জেলে বসেই ছাপাখানার কাজ করতেন। সেখানে বিজ্ঞাপন, দলিল, দিনপঞ্জিকা ইত্যাদি ছাপানোর কাজ করতেন। কিছুদিন পর যখন দেখলেন ছাপাখানায় বেশি সুবিধা করতে পারছেন না, তখন তিনি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৭৮০ সালে, কলকাতার ৬৭ নম্বর রাধাবাজার থেকে প্রকাশিত হলো হিকির বেঙ্গল গেজেট।
হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশ করার পেছনে তখনকার গভর্নর জেনারেল পরিষদের অন্যতম সদস্য স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিসের পরোক্ষ হাত ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। সম্ভবত ফ্রান্সিসের সহযোগিতায় হিকি সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। হিকির গেজেট সবসময় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে উচ্চকিত ছিল।
হিকির পত্রিকার পাঠকশ্রেণি ছিল বেসরকারি ইংরেজ ব্যক্তিরা, ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে আসা ইউরোপিয়ানরা। নিয়মিত পাঠকরা চিঠি লিখত। চিঠিতে লেখা হতো তৎকালীন প্রশাসনের বিভিন্ন দুর্নীতির খবরাখবর, অভাব-অভিযোগ। আদালতের বেআইনি কাজকর্ম, সিক্কা মুদ্রা বাতিলের ফলে অসুবিধাসহ প্রশাসনের আরও নানা অপকর্ম উঠে আসতো হিকির পত্রিকায়। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য যেমন হিকির শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তেমনি হিকির শত্রুও বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
বিশেষ করে গভর্নর হেস্টিংস এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধানবিচারপতি ইলিজা ইম্পে আরও বেশি ক্ষেপে যান। হেস্টিংস একের পর এক মামলা দিতে থাকেন হিকির বিরুদ্ধে। তিনি এবং ইলিজা ইম্পে সুযোগ খুঁজতে থাকেন হিকিকে জব্দ করার। এক সময় হিকি গ্রেপ্তার হন। ১৭৮২ সালে, পত্রিকা প্রতিষ্ঠার মাত্র দুবছরের মাথায় হেস্টিংসের ইঙ্গিতে হিকির বেঙ্গল গেজেট বায়েজাপ্ত করা হয়। ফলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে হিকি ছিলেন সোচ্চার ও আপসহীন। তিনি কারও মতের দ্বারা প্রভাবিত হননি এবং শেষ দিন পর্যন্ত কারও তোয়াক্কা না করে নিজের স্বাধীন মতামত ও নীতির প্রতি অবিচল থেকে পত্রিকা প্রকাশ করে গেছেন। তিনি সরকারের বহু নীতি ও কাজকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনামূলক সম্পাদকীয়, নিবন্ধ, ব্যঙ্গাত্মক রচনা প্রকাশ করছেন। যদিও নৈতিকতা এবং জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করলে তার পত্রিকার নীতি ও লেখা কতখানি সঠিক কিংবা উপকারী ছিল, সে সম্পর্কে বিতর্ক তোলা যেতে পারে। তবে শাসকের রক্তচক্ষু তাকে টলাতে পারেনি। সে বিচারে হিকি ছিলেন নিঃসন্দেহে সাহসী, আপসহীন ও সংগ্রামী সাংবাদিক।
হিকি সম্পর্কে মার্গারিটা বানর্স তার ‘দি ইন্ডিয়ান প্রেস : এ হিস্ট্রি অব দ্য গ্রোথ অব পাবলিক ওপিনিয়ন ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হিকির সাহস ছিল প্রচণ্ড এবং হারিয়েছেনও অনেক কিছু; কিন্তু তবুও তার নামটুকু বেঁচে আছে।’
উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত হিকিজ বেঙ্গল গেজেটের মাত্র চারটি পূর্ণাঙ্গ কপি টিকে আছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে