Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

উদ্বোধনী সংখ্যা ৩ : ফিরে দেখা ২০২৩

সাফল্য ছাপিয়ে গেছে ব্যর্থতার গল্প

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩

ন্তর্জাতিক মঞ্চে ৩২ ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশের ১১ জয়। হার সংখ্যা ১৮, বাকি তিন ম্যাচ ফলশূন্য। টি-২০তে (নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৩ ম্যাচ সিরিজের আগ পর্যন্ত) ৮ খেলায় ৭ জয়, হার একটি। চার টেস্টে তিন জয়, হার একটি। ২০২৩ সালের এ পরিসংখ্যান দেশের ক্রিকেটের আসল চিত্রটা বোঝাতে পারছে না। বাংলাদেশে ক্রিকেট যে নানা ব্যাধিতে জর্জরিত—তা গাণিতিক হিসেবে ধরা পড়বে না। ফুটবলে ১৪ ম্যাচে ৫ জয়, ৪ হার ও ৫ ড্রয়ের পরিসংখ্যানও প্রকৃত চিত্র বোঝাতে ব্যর্থ। নানা জটিলতা-সীমাবদ্ধতা ঢেকে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে ফুটবল। ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে সাফল্য নেই, ২০২৩ সালের প্রায় পুরোটাই ব্যর্থতার গল্প।

ক্রিকেট আবেগে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার ঘা
শুরুর আগে অতি আবেগে যারা সেমিফাইনালের হিসাব কষেছেন; আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ শেষে তারাই দুয়োধ্বনি তুলতে কাঁধে কাঁধ মেলান। আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ে শুরু, অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার দিয়ে শেষ। মাঝে বাংলাদেশ যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলল, তা যেন হৃদয়বিদারক! বিশ্বকাপ পরবর্তী ক্রিকেটামোদিদের প্রতিক্রিয়ায় সেটাই মনে হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবেক নয়, আবেগই ছিল ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণের মানদণ্ড। এ কারণেই বোধ করি অহেতুক প্রত্যাশার বেলুন ফুলেছে; চুপসে যেতেও সময় লাগেনি।

বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে বাংলাদেশের ২ জয়, বাকি ৭ ম্যাচে হার। ৭ হারের একটি আবার মিনোস নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। আপনার আবেগ হয়তো বলছে—এটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের আসল চিত্র নয়; কিন্তু বাস্তবতা বলছে—এমনটি না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক ছিল। আধুনিক ক্রিকেটে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া আছে, কাজের পরিসীমাও। সেখানে অপরিসীম কেবল কিছু বোর্ড কর্মকর্তার বিচরণক্ষেত্র। দল নির্বাচন, একাদশ ঠিক করা, এমনকি ব্যাটিং অর্ডার সাজানো ইস্যুতেও তাদের কথা বলতে শোনা যায়। সব বিষয়ে যখন নন-টেকনিক্যাল ব্যক্তির এক্সেস থাকে; তখন আপনাকে বুঝে নিতে হবে দলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সঠিক পথে নেই। প্রতিপক্ষ দলগুলো তিন-চার বছরের একটা চক্র পূরণ করে; সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে আসে। সেখানে আপনি যেনতেনভাবে একটা দল পাঠিয়ে সেমিফাইনাল খেলে আসবেন—এমনটা কল্পনা করাও পাপ!

রাহুল দ্রাবিড়ের অধীনে রোহিত শর্মার নেতৃত্বে ভারত দীর্ঘদিন যে প্রস্তুত হয়েছে, তার প্রতিফলন দেখা গেছে বিশ্বকাপ মঞ্চে। ফাইনাল হারের আগে স্বাগতিকরা রীতিমতো নিখুঁত ক্রিকেট খেলেছে। শুরুর ধাক্কা সামলে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বজয়ের উল্লাসের পেছনেও সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা ছিল। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলের চিত্রটা নিশ্চই ভুলে যাননি। বোর্ড কর্তাদের অযাচিত কথাবার্তার কারণে ক্ষোভ-অভিমানে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম ইকবাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সিদ্ধান্ত বদলান, বিশ্বকাপ খেলার সিদ্ধান্ত নেন অভিজ্ঞ ওপেনার। আসর শুরুর আগমুহূর্তে ব্যাটিং অর্ডার-সংক্রান্ত মতবিরোধে দলের বাইরে ছিটকে গেছেন সেই তামিম ইকবাল। অভিজ্ঞ ব্যটার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বিশ্বকাপ দলে থাকা না থাকা ইস্যুতে বছরজুড়েই আলো-আঁধারির খেলা হয়েছে। অনিশ্চয়তার মেঘ দূরে ঠেলে বিশ্বকাপ কন্টিনজেন্টে যুক্ত হন মাহমুদউল্লাহ। ৮ ম্যাচের ৭ ইনিংসে ব্যাটিং করে সর্বোচ্চ ৩২৮ রান সংগ্রাহক বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া অভিজ্ঞ এ ক্রিকেটারই। এই যখন একটা দলের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তখন বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে নৈপুণ্যটা কি আদৌ অস্বাভাবিক! এ তো গেল বিশ্বকাপের মতো মেগা আসরের প্রস্তুতি-সংক্রান্ত লেজে-গোবরে অবস্থার চিত্র।

তার বাইরে দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিও সমর্থকদের জন্য সুখকর নয়; বরং এটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার পথে বাধার দেয়াল তুলে দিচ্ছে। বছরের পর বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে চলছে সাফল্য-ব্যর্থতার ইঁদুর-বিড়াল খেলার অদ্ভুত এক পদ্ধতি অনুসরণ করে। ঘরের মাঠে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে পছন্দ মতো উইকেট তৈরি করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে সাফল্যের পাল্লা ভারী হচ্ছে। প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে খেই হারিয়ে সেটা সমান হয়ে যাচ্ছে। অ্যাওয়ে সিরিজে স্পোর্টিং উইকেট পেলে কালেভদ্রে গর্জে উঠছে টাইগার, বাকি সময় থাকছে গড়পড়তা মানের দল হয়ে। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই সেটা পরিষ্কার হচ্ছে। ৪ টেস্টের সবই ঘরের মাঠে খেলেছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-২০ সিরিজেও স্বাগতিক ছিল লাল-সবুজরা। বিপরীতে অধিকাংশ ওয়ানডে খেলতে হয়েছে দেশের বাইরে। তিন ফরম্যাটের মধ্যে টেস্ট ও টি-২০তে সাফল্যর বিপরীতে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে এ বছর চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। অথচ নিকট অতীতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে এটাই ছিল টাইগারদের সবচেয়ে সফল ফরম্যাট। ২০২২ সালে এ ফরম্যাটে ১৫ ম্যাচের ১০টি জিতেছিল বাংলাদেশ। হোম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার এ প্রবণতার কুফল কেমন হতে পারে এশিয়া কাপ-আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। দেখিয়েছে সাম্প্রতিক নিউজিল্যান্ড সফরও।

তার আগে, বছর শুরু হয়েছিল মার্চে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে হেরে। প্রথম দুই ম্যাচেই সিরিজ নিশ্চিত করে নিয়েছিল অতিথিরা। শেষ ম্যাচে স্বাগতিকদের জয়টা ছিল সান্ত্বনার উপলক্ষ। তিন ম্যাচ টি-২০ সিরিজে ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশ করে ওয়ানডে হারের ক্ষতে স্বস্তির ফু দিতে পেয়েছিল বাংলাদেশ।

মার্চ-এপ্রিলে ঘরের মাঠে একমাত্র টেস্টে আয়ারল্যান্ডকে ৭ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজ স্বাগতিকরা জিতেছে ২-১ ব্যবধানে। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে জয় ২-০ ব্যবধানে। সিলেটে দ্বিতীয় ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার আগে-পরে ১৮৩ রান ও ১০ উইকেটের বড় জয় আসে।

মে মাসে আয়ারল্যান্ড সফরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-০ ব্যবধানে জিতেছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পর টানা দুই জয়। জুন-জুলাইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট ৫৪৬ রানে জয়ের পর ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ হারতে হয়েছে ২-১ ব্যবধানে। দুই ম্যাচের টি-২০ সিরিজে আফগানদের হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে হওয়া এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার কাছে হারের পর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৮৯ রানের জয়ে সুপার-ফোর নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। সুপার-ফোরে তিন ম্যাচের দুটি হারা বাংলাদেশের এশিয়া কাপ মিশন শেষ হওয়ার আগে ভারতের বিপক্ষে সান্ত্বনার জয় পায়। সেপ্টেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ স্বাগতিকরা ২-০ ব্যবধানে জিতেছে। বিশ্বকাপের আগে ঘরে-বাইরে খেলা উপরোল্লিখিত সিরিজ ও প্রতিযোগিতায় দিয়ে দল গোছানোর সুযোগ ছিল। উল্টো দলে বিভেদ প্রকট হয়েছে, নড়বড়ে হয়েছে অনেক ক্রিকেটারের আত্মবিশ্বাস। নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস নিয়েই বিশ্বকাপ খেলে এসেছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে নভেম্বর-ডিসেম্বরে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ ড্র করেছে বাংলাদেশ। ফিরতি ট্যুর শুরু হয়েছে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটিতে ৪৪ রানের হার দিয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে সৌম্য সরকারের অতি মানবীয় ১৬৯ রানের ইনিংসের পরও হার ৭ উইকেটে। যার অর্থ এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ নিশ্চিত করেছে নিউজিল্যান্ড। সিরিজ হারের পর শেষ ম্যাচে ছিল ৯ উইকেটের সান্তনার জয়। নিউজিল্যান্ড সফরে তিনটি টি-২০ ম্যাচও খেলেছে বাংলাদেশ।

ফুটবলে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা
ডাচ কোচ লোডউইক ডি ক্রুইফ স্বপ্ন দেখিয়ে ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙতে পারেননি। একই পথে হেঁটেছেন ইংলিশ কোচ জেমি ডে। বাংলাদেশ ফুটবলে হাভিয়ে ক্যাবরেরা যুগের সূচনাও সুখকর ছিলনা। শুরুর দিকে ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেলেও দেশের ফুটবলের প্রকৃত অসুখটা ধরতে পেরেছেন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ফুটবল বিশ্লেষণ ও পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা স্প্যানিশ কোচ। প্রথাগত নাম্বার নাইন নিয়ে খেলার প্রবণতা থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনেন এ কোচ। দুই উইংয়ে রাকিব হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ ফাহিম; তাদের মাঝে শেখ মোরসালিন। অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকেও বিভিন্ন ম্যাচে বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে দেখা গেছে। এ কৌশল সবসময় গোলমুখ খুলতে পারছে না ঠিক; কিন্তু প্রতিপক্ষ রক্ষণে ভীতি ছড়ানো যাচ্ছে নিয়মিত, যা ক্রমেই দেশের ফুটবলকে বদলে দিচ্ছে। বাংলাদেশও এখন আর হারার আগে হেরে বসছে না।

ক্যাবরেরার বদলে দেয়ার অধ্যায় শুরু হয়েছিল মার্চে সৌদি আরবে ক্যাম্প করার মাধ্যমে। সফরে মালাউইর বিপক্ষে আন-অফিসিয়াল প্রীতি ম্যাচে ১-১ গোল ড্র করে বাংলাদেশ। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মার্চেই সিশেলসের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলে লাল-সবুজরা। প্রথমটিতে ১-০ গোলের জয়, পরের ম্যাচ একই ব্যবধানে হারতে হয়েছে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর আগে আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া দিয়েছে জুনে কম্বোডিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়। বেঙ্গালুরু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে লেবাননের কাছে ২-০ গোলের হারে মিশন শুরু হলেও লাল-সবুজরা দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলেছে। ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে গোল হজমের পর যে প্রক্রিয়ায় দল ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা গেল এক যুগে দেখা যায়নি। পরের দুই ম্যাচ ৩-১ ব্যবধানে জিতে সাফ সেমিফাইনালে নাম লেখায় হাভিয়ে ক্যাবরেরার দল। এটি ছিল আসরে ২০০৯ সালের পর বাংলাদেশের প্রথম সেমিফাইনাল। প্রতিযোগিতার সবচেয়ে শক্তিশালী দল কুয়েতের সঙ্গে নির্ধারিত সময় গোলশূন্য, অতিরিক্ত সময়ে গোল হজম করে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়ানোর পালা শুরু হয়েছিল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়েই। আসরের সেরা গোলরক্ষকের স্বীকৃতি পান বাংলাদেশের আনিসুর রহমান জিকো।

ভিন্ন ধাঁচের ফুটবল প্রদর্শনী অব্যাহত ছিল আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই প্রীতি ম্যাচেও। সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা আফগানদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ গোলশূন্য, পরেরটি ১-১ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ। বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বৈরথ ছিল মালদ্বীপের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্রথম রাউন্ডে। হোম এন্ড অ্যাওয়ে লড়াইয়ে হারলে আগামি তিন বছর ফিফা-এএফসির সূচিভুক্ত ম্যাচের বাইরে ছিটকে যেতে হতো। মালদ্বীপে গিয়ে ১-১ গোলে ড্র করে আসে বাংলাদেশ। ঢাকায় ২-১ গোলের জয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা করে নেয় হাভিয়ের ক্যাবরেরার শিষ্যরা। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে বিশ্ব ফুটবল অভাবনীয় উন্নতি করা অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৭-০ গোলে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ। ঢাকায় লেবাননের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে অস্ট্রেলিয়ার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

হাভিয়ের ক্যাবরেরা বাংলাদেশকে লড়াকু ফুটবল খেলিয়েছেন এশিয়ান গেমসেও। ‘এ’ গ্রুপের প্রথম দুই ম্যাচ যদিও হারতে হয়েছে; কিন্তু ম্যাচ দুটিতে অনেক ইতিবাচক বিষয় ছিল। মিয়ানমারের কাছে হার হাসান মুরাদের আত্মঘাতী গোলে। ভারতের কাছে হারতে হয়েছে সুনীল ছেত্রীর পেনাল্টি গোলে। স্কোর-লাইন অবশ্য ম্যাচের গতিপ্রকৃতি বোঝাতে পারছে না। প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ম্যাচ দুটির স্কোর-লাইন ভিন্নও হতে পারত। শেষ ম্যাচে স্বাগতিক চীনের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে বাংলাদেশ।

এশিয়াডেই সীমাবদ্ধ সাফ জয়ী নারী দল
নেপালে সাফ জয়ের পর অলিম্পিক বাছাই পর্বে দল পাঠায়নি বাংলাদেশ। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। সাফ জয়ী কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন ও গোলরক্ষক কোচ মাসুদ আহমেদ উজ্জলের দায়িত্ব ছাড়াও ছিল নারী দলকে ঘিরে বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ২০২৩ সালের সাবিনা খাতুনদের একমাত্র প্রতিযোগিতা ছিল এশিয়ান গেমস। তিন ম্যাচের দুটি হারা বাংলাদেশ শেষ ম্যাচে নেপালের সঙ্গে ড্র করে। গেমসের আগে নেপালের বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজ শেষ হয় ১-১ ও ০-০ সমতায়। দুই ম্যাচের সিরিজে সিংগাপুরকে উড়িয়ে দিয়ে বছরের শেষটা রাঙিয়েছে সাবিনা খাতুনের দল। প্রথম ম্যাচে ৩-০, দ্বিতীয় ম্যাচে জয় ৮-০ গোলে। দারুণ দুটি জয়ে বছর শেষ করলেও নারী ফুটবল কার্যক্রম শঙ্কা জাগিয়েছে। অনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে, একাধিকবার তারিখ পরিবর্তন করেও নারী সুপার লিগ আয়োজন করা যায়নি। নারী লিগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বসুন্ধরা কিংসও। সব মিলিয়ে নারী ফুটবলে গুমোট পরিস্থিতিতেই নতুন বছর শুরু করছে বাংলাদেশ।

আর্জেন্টিনায় জামাল ভূঁইয়া
গেল মৌসুমেই আর্জেন্টিনার ক্লাব থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। মৌসুমের মাঝপথে প্রস্তাব এসেছিল বলে সাড়া দেয়া হয়নি। নতুন মৌসুম শুরুর আগে ফের প্রস্তাব পাওয়ার পর বাংলাদেশ ছেড়ে আর্জেন্টিনায় পাড়ি জমান এ মিডফিল্ডার। নাম লেখান আর্জেন্টিনার পেশাদার লিগ কাঠামোর তৃতীয় স্তরের দল সোল দি মায়ো ক্লাবে। জামাল ভূঁইয়ার অভিষেকটা ছিল রাজসিক—নিজে গোল করেছেন, দলও জয় পেয়েছে।

এশিয়ার মঞ্চে বসুন্ধরা কিংস
২০১৯ সালে আবাহনী এএফসি কাপের আঞ্চলিক সেমিফাইনাল খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশি ক্লাবগুলোর এএফসি রেটিং বৃদ্ধি পায়। সুফল হিসেবে ২০২৩ সালে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্লে-অফ খেলেছে বসুন্ধরা কিংস। আরব আমিরাতের ক্লাব শারজাহ এফসির বিপক্ষে ২-০ গোলের হার দিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মিশন শেষ হয় কিংসের। পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সরাসরি এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে খেলেছে ক্লাবটি। হার দিয়ে অভিযান শুরুর পর একপর্যায়ে গ্রুপের শীর্ষস্থানে উঠে আসে বসুন্ধরা কিংস। শেষ ম্যাচে উড়িশা এফসির কাছে হারে আঞ্চলিক সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ হারায় টানা চারবারের প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়নরা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যর্থ হলেও স্বাধীনতা কাপ জিতে মৌসুম শুরু করে বসুন্ধরা কিংস।

মদকাণ্ড
মালদ্বীপের ক্লাব মাজিয়া স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন সেন্টারের বিপক্ষে এএফসি কাপ ম্যাচ খেলে ফেরার পথে মদ নিয়ে বিমানবন্দরে ধরা পড়েন বসুন্ধরা কিংসের পাঁচ ফুটবলার—তপু বর্মণ, আনিসুর রহমান জিকো, শেখ মোরসালিন, রিমন হোসেন ও তৌহিদুল আলম সবুজ। আলোচিত এ ঘটনায় পাঁচ ফুটবলারকে নিষিদ্ধ করা হয়, দেয়া হয় অর্থদণ্ডও। তৌহিদুল আলম সবুজ ছাড়া বাকিরা নিষেধাজ্ঞা শেষে ক্লাবে ফিরেছেন।

গড়পড়তা হকি
ওমানে স্বাগতিকদের হারিয়ে জুনিয়র এএইচএফ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। সুবাদে জুনিয়র এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে লাল-সবুজরা। ওমানে অনুষ্ঠিত জুনিয়র এশিয়া কাপে শীর্ষ চার-এ নাম লেখানোর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের। সেটা করতে পারলে জুনিয়র বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জিত হতো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১০ জাতির আসরে ৬ষ্ঠ স্থান নিয়ে ফিরতে হয়েছে। পরবর্তীতে ১২ জাতির এশিয়ান গেমস হকিতে ৮ম স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ।

রোমান সানার ফেরা
সতীর্থকে পিটিয়ে জাতীয় দল থেকে নিষিদ্ধ হওয়া রোমান সানা বছরের মাঝপথে মুক্ত হন। সরাসরি অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জনের একাধিক পরীক্ষা দেয়া বাংলাদেশি তীরন্দাজরা সুফল তুলতে পারেননি। সাফল্য-ব্যর্থতা ছাপিয়ে আরচারিতে আলোচিত হয়ে আছে রোমান সানার ফিরে আসা।

ব্যর্থতার এশিয়াড
বিশ্ব ও এশিয়ান আরচারির নিচু সারির প্রতিযোগিতায় নিয়মিত পদক জয় করে আসছে বাংলাদেশ। এ অর্জনগুলোকে সাফল্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টায় লিপ্ত সংশ্লিষ্টরা। আদতে এশিয়া ও বিশ্বমান যে দূরের পথ সেটা প্রমাণ মিলেছে এশিয়ান গেমসে বড় মঞ্চে।

গেমস শুরুর আগে বাংলাদেশ স্বপ্নের কেন্দ্রে ছিলেন দুই প্রবাসীর—বক্সার জিন্নাত ফেরদৌস ও স্প্রিন্টার ইমরানুর রহমান। দুই ক্রীড়াবিদের কেউ যে স্বপ্ন দেখার মতো অবস্থায় ছিলেন না এটা ক্রীড়াঙ্গনের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা ব্যক্তিরা বুঝলেও বুঝতে পারেননি ক্রীড়াঙ্গনের নীতি-নির্ধারকরা। ইমরানুর মূলত ৬০ মিটার স্প্রিন্টের উপযোগী অ্যাথলেট। এশিয়ান গেমসের মতো বড় মঞ্চে তার প্রাপ্তির সুযোগ ছিল না কখনোই; কিন্তু অ্যাথলেটিকস কর্মকর্তারা মন ভোলানো প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতি মাসে ৭-৮ লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করিয়েছেন ইমরানুরের পেছনে। জিন্নাত ফেরদৌসের ক্ষেত্রেও ছিল ‘ভুল জায়গায়’ বিনিয়োগ! প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ের গেমসে বাংলাদেশের প্রাপ্তি দুটি ব্রোঞ্জপদক—নারী ও পুরুষ ক্রিকেট থেকে। বিপুল বিনিয়োগের বিপরীতে চরম ব্যর্থতা নিয়ে বেশ সমালোচিত হয়।

লেখক: সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ