Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

নিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার অর্থনীতির সাফল্য অসম্ভব

M A  Khaleque

এম এ খালেক

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

পায়ে রশি বেঁধে উন্মুক্ত দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যেমন বিজয়ী হওয়া যায় না, তেমনি শর্তাধীনে মুক্তবাজার অর্থনীতি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ করা হলে মুক্তবাজার অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত সুফল কখনোই পাওয়া যায় না। তাই বলে মুক্তবাজার বা ফ্রি মার্কেট ইকোনমি অর্থ ফ্রি স্টাইল ইকোনমি নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সব সব সময় দৃষ্টি রাখতে হয় কোনো কারণে মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি যাতে রুদ্ধ না হয়। কোনো অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হলেই কেবল নিয়ন্ত্রক সেখানে হস্তক্ষেপ করবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি বলে মনে করা হয়। কোনো পণ্য বা সেবার মূল্য নির্ধারিত হবে বাজার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। কোনো মহল বাজারে একটি পণ্যের মূল্য বা জোগান নির্ধারণ করে দেবে না। পণ্যের জোগান বা উপস্থিতি এবং ভোক্তার চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে। এটাই মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল ভিত্তি বা সৌন্দর্য। যেসব দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মুক্তভাবে চলতে দেয় না তারাই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়।

বাংলাদেশ গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে আসছে; কিন্তু এখনো বাজার পুরোপুরি মুক্তভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত সুফল আমরা পাচ্ছি না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে; কিন্তু এ ব্যাপারে কারও কোনো দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে যা চলছে, তা কার্যত নিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার অর্থনীতি বলা যেতে পারে। নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি কীভাবে একটি দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে আমি এখানে তা আলোচনা করার চেষ্টা করব।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সরকারের শীর্ষ মহল থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হন; কিন্তু তাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার মতো পরিবেশ এবং সুযোগ দিতে হবে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দিতে হয়; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত দ্বৈত শাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের যতটা নিয়ন্ত্রণ আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে ততটা নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তা বাতিল করে দিতে পারে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সিদ্ধান্তে আপত্তি জানালেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ চাইলে তা বাস্তবায়ন করতে পারে। সর্বশেষ ব্যক্তি মালিকানায় যে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেই ক্ষেত্রে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল বলে অনেকেই বলে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে ব্যাংক অনুমোদন দানে আপত্তি জানালেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। সেই সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, এ মুহূর্তে দেশে আর কোনো ব্যাংকের প্রয়োজন নেই; কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হলো। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো কোনো সংস্থাকে অনুমোদন দেয়া হলে তার পরিণতি কি হতে পারে, তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি।

বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝে মাঝেই এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা দেশের ব্যাংকিং সেক্টর তথা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর; কিন্তু তারপরও তারা এই সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। তারা নিজেরা এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই বরং তারা মহল বিশেষের চাপে এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ক্ষতিকর। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর রাজধানীর একটি হোটেলে দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য অঙ্গীকার করেছিলেন। পরে সেই অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত ৯-৬ সুদ হার বাস্তবায়ন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ করা হয়। ২০২২ সালে যখন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হার অনেক বেশি ছিল। এমন কি বাংলাদেশের ব্যাংক ঋণের ব্যাপক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সুদের হার বেশি হওয়াটাই ছিল সঙ্গত; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়, যা ছিল মুক্তবাজার অর্থনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতের ওপর সুদের হার দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য ছিল আমানতকারীরা যাতে রাষ্ট্রীয় মালিনাকাধীন ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ না করে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত রাখেন। এমন কি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে সীমা ছিল, তা কমিয়ে দেয়া হয়। এতে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আমানত সংরক্ষণের দ্বার উন্মোচিত হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ করতে গিয়ে পরবর্তীতে বিপদে পড়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় সেই সময় আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, তাদের ‘কস্ট অব ফান্ড’ ছিল সোয়া ৮ শতাংশ। কোনো ব্যাংক একশত টাকা বিনিয়োগযোগ্য তহবিল গঠন করার জন্য যদি সোয়া ৮ টাকা ব্যয় করে, তাহলে সেই ব্যাংকের পক্ষে কি ৭৫ পয়সা মুনাফা রেখে ঋণ দান করা সম্ভব? ব্যাংকগুলো এই সময় ঋণের ওপর নানা ধরনের চার্জ আরোপ করে তাদের ব্যবসায় পরিচালনার চেষ্টা করেছিল।

ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার নির্ধারণ করে দেয়ার ফলে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছিল। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের সুবিধা দেবার জন্য ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। এতে ব্যাংকগুলোর মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পায়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী তারা বিভিন্ন উপায়ে ঋণ মঞ্জুর করিয়ে নেয়। সেই সময় এক মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ; কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। একই সময় শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমেছিল। তার অর্থ হচ্ছে গৃহীত ব্যাংক ঋণ সঠিকভাবে উদ্দিষ্ট খাতে ব্যয় না করে অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। ঋণের অর্থ কোনো না কোনোভাবে বাজারে চলে এসেছিল। ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। সেই সময় মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) তাদের পলিসি রেট বাড়িয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পলিসি রেট বৃদ্ধি করে। অর্থনীতির সূত্র মতে, কোনো সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি পলিসি রেট বৃদ্ধি করে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সিডিউল ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণের সময় আগের তুলনায় বেশি সুদ প্রদান করতে হয়। এতে উদ্যোক্তা পর্যায়ে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে আগের মতো অধিক হারে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা হ্রাস পায়। বাজারে অর্থপ্রবাহ কমে যায়, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অধিকাংশ দেশ তাদের অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়। এমনকি অর্থনৈতিক সমস্যা সংকুল শ্রীলঙ্কাও একই ভাবে তাদের মূল্যস্ফীতির হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশের নিচে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে পলিসি রেট বেশ কয়েকবার বৃদ্ধি করেছে। অনেক দিন ধরেই পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা বাড়তে বাড়তে সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; কিন্তু কিছু দিন আগেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট বৃদ্ধি তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। পলিসি রেট বাড়ানোর পাশাপাশি একই সময়ে ব্যাংক ঋণের সুদের হার যদি নিয়ন্ত্রিত না রেখে বাজারভিত্তিক করা হতো তাহলে মূল্যস্ফীতির ওপর তা প্রভাব বিস্তার করতে পারতো। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন ব্যাংক ঋণের সুদের হার এখনো পুরোপুরি বাজার ভিত্তিক করছে না কেনো তা বোধগম্য হচ্ছে না।

মুক্তবাজার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রিত বা শৃঙ্খলিত করার পরিণতি কি হতে পারে তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত করে রাখা। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কোনোভাবেই মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক নয়। বর্তমানে বাজারে মার্কিন ডলারের একাধিক বিনিময় হার চালু আছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো মনে করছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হবে। এতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। গণদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে। অর্থনীতির সূত্র সেটাই বলে; কিন্তু এর বিপরীতেও কথা আছে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে আমদানি ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে আমদানিকারকদের চাহিদা মতো মার্কিন ডলারের জোগান নিশ্চিত করতে হবে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে অবস্থা তাতে চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিকারকদের পর্যাপ্ত পরিমাণ মার্কিন ডলার জোগান দিতে পারবে না। এই অবস্থায় আমদানিকারকরা কিন্তু বসে নেই। তারা পণ্য আমদানি করছে। কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চ মূল্যে মার্কিন ডলার ক্রয় করে তারা পণ্য আমদানি করে স্থানীয় বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছে। ফলে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারিত করে রাখার মূল উদ্দেশ্যই বিঘ্নিত হচ্ছে। অপর দিকে এই উদ্যোগ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি মার্কিন ডলার যে মূল্যে বিক্রি হচ্ছে কার্ব মার্কেটে তার চেয়ে অন্তত ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য থাকে ১ থেকে ২ টাকা। কার্ব মার্কেটে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি পাবার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন ক্রমেই কার্ব মার্কেটমুখী হচ্ছেন। গত বছর প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আহরণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে ছিল; কিন্তু গত বছর রেকর্ড পরিমাণ ১৩ লাখ শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থান উপলক্ষে গমন করেছে। সদ্য বিদায়ী রমজান মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করে তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কম। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটল। তার অর্থ কি এই যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স প্রেরণ কমিয়ে দিয়েছে? না, তারা রেমিট্যান্স ঠিকই দেশে প্রেরণ করেছে। তবে তা করেছে হুন্ডির মাধ্যমে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে। সেই অর্থের বিনিময়ে যেখানে বেশি টাকা পাবে সেখানেই তারা বৈদেশিক মুদ্রা ভাঙাবে বা প্রেরণ করবে। ব্যাংকগুলো প্রথমে প্রবাসী আয়ের উপর নগদ ২ শতাংশ হারে আর্থিক প্রণোদনা দিতো। এখন নেই প্রণোদনার হার ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। তারপরও উপার্জিত সব রেমিট্যান্স কেন বৈধপথে আসছে না, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? ৫ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনাসহ প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে ১১৫ টাকা পাওয়া যায়। সেই একই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরণ করলে অন্তত আরও ১০ টাকা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। কে এই সুবিধা হারাতে চাইবে? সরকার যদি হুন্ডি ব্যবসায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ অথবা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যাই হোক না কেনো প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করতেন; কিন্তু তা কি সম্ভব? ঘোড়ার গলায় ঘণ্টা বাঁধা প্রয়োজন; কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঘণ্টাটি বাঁধবে কে?

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যদি বাজারভিত্তিক করা হতো তাহলে এ মুহূর্তে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে স্থানীয় মুদ্রায় অন্তত ১২৮-১২৯ টাকা পাওয়া যেত। এটা করা হলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে উৎসাহী হতেন। মনে রাখতে হবে, শুধু কথায় চিড়া ভিজে না। তেমনি অর্থ গচ্চা দিয়ে দীর্ঘ দিন মানুষ দেশপ্রেম প্রদর্শন করে না। একটা না একটা সময় মানুষ অর্থের লোভের নিকট নতি স্বীকার করবে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে দেশে প্রেরণ করছে তা নানাভাবে আবারো বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমদানিকারকদের অনেকেই কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চ মূল্যে মার্কিন ডলার ক্রয় করে পণ্য আমদানি করছে। কেউ বা বিদেশে অর্থ পাচারের সময় এই বৈদেশিক মুদ্রাকে ব্যবহার করছেন। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার যদি বাজারভিত্তিক থাকতো তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করতেন। সেই রেমিট্যান্সকৃত অর্থ এক পর্যায়ে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যুক্ত হতো। বর্তমানে আমরা যে রিজার্ভ সংকট প্রত্যক্ষ করছি সেই সংকট অনেকটাই কমে যেত। যারা পণ্য রপ্তানি করেন তারাও তাদের উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশই বিদেশ রেখে দিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পেলে তখন এই অর্থ বিদেশে থেকে দেশে নিয়ে আসবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ কখনোই সফল হবে না যদি সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ খেলাপিদের দেয়া বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা বাতিল করা না হয়। বিশেষ করে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তা বাতিল করা না হলে কোনোভাবেই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ সফল হবে না।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ